কালোজিরার তেল এর উপকারিতা
কালোজিরা কে বলা হয় ‘মৃত্যু ছাড়া সর্ব রোগের মহৌষধ’। রান্না ছাড়াও প্রাচীনকাল থেকেই নানা অসুখ-বিসুখে কালো জিরার তেল ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের জন্যই না, কালোজিরার তেল চুল ও ত্বকের জন্যও অনেক উপকারি।
প্রতি ১০০ গ্রাম কালোজিরায় রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন বি, নিয়াসিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, কপার, জিংক এবং ফোলাসিন। এছাড়াও এতে রয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ আমিষ, ৩৮ শতাংশ শর্করা, এবং ৩৫ শতাংশ ভেষজ তেল ও চর্বি। আসুন আজকে আমরা আশ্চর্য বীজ কালোজিরার তেল এর উপকারিতা গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
আরও দেখুনঃ পুরুষাঙ্গে কালোজিরার তেল ব্যবহারের নিয়ম
কালোজিরার তেল এর উপকারিতা
ত্বকের আদ্রতায়ঃ কালোজিরার তেল মাখলে ত্বকে আদ্রতা ফিরে আসে ও ত্বকের বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ প্রশমিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে দিনে দুইবার করে চার সপ্তাহ পর্যন্ত কালোজিরার তেল প্রয়োগে হাতের একজিমা কমে যায়। এটা ওভার দা কাউন্টার ইউসেরিন লোশন ও প্রেসক্রিপশন ট্রপিক্যাল স্টেরয়েড বিটামিথাসনের মতই কাজ করে।
উচ্চ রক্তচাপ কমায়ঃ গবেষণায় দেখা গেছে কালোজিরার তেল উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দিনে দুইবার করে আধা চা চামচ কালোজিরার তেল সেবনে উচ্চ রক্তচাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে। ধারণা করা হয় যে কালোজিরার তেলের উজ্জ্বল থাইমো কুইনন রক্তচাপ কামানোর প্রধান হিসেবে কাজ করে।
চুল গজাতে সাহায্য করেঃ নিয়মিত কালোজিরার তেল ব্যবহারে চুল আরো ঘন হয় ও চুল পড়া কমায়। গবেষকদের মতে কালোজিরার তেলে বিদ্যমান প্রোটিন ও ফ্যাটি এসিড রক্ত চলাচল বাড়িয়ে চুল গজাতে ও বিকাশ সাধনে সহায়তা করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে শেভ করা মাথার চার স্থানে নারকেল তেল ও কালোজিরার তেলের মিশ্রণ এবং নারকেল তেল ও অন্যান্য তেলের মিশ্রণ দিয়ে দেখা গেছে যে যেখানে নারকেল তেল ও কালোজিরা তেলের মিশ্রণ দেওয়া হয়েছে সেখানে চুলের ঘনত্ব অনন্যস্থানের তুলনায় অনেক বেশি।
শুক্রাণু সংখ্যা বাড়াতেঃ নিয়মিত কালোজিরার তেল সেবনে পুরুষদের শুক্রানুর সংখ্যা বাড়ে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে অনুর্বর পুরুষদের একটি গ্রুপকে প্রতিদিন ২.৫ মিলি কালোজিরার তেল এবং আরেকটি গ্রুপকে প্লাসেবো পান করতে দেওয়া হয়েছে। আড়াই মাস পর দেখা গেছে যারা কালো জিরার তেল পান করেছেন তাদের শুক্রাণুর সংখ্যা তুলনামূলক অন্যদের তুলনায় বেড়েছে। এমনকি শুক্রানুর গতিশীলতা ও বেড়েছে।
ব্রণ সারায়ঃ ত্বকের প্রদাহ কমিয়ে ব্রণ সারাতে ও তোকে তার অন্য ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করে কালো জিরার তেল। ড্রোনের স্থানে ২০ শতাংশ কালোজিরার তেল সমৃদ্ধ ক্রিম মাখলে অনেক ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। একটি গবেষণায় প্রথম গ্রুপ কে বিশ শতাংশ কালোজিরার তেলের লোশন ও আরেকটি গ্রুপকে ৫% বেঞ্জয়াল পারঅক্সাইড লোশন দেওয়া হয়। এতে দেখা যায় উভয়েই ব্রণ কমাতে ও সারাতে সমান কার্যকর ছিল। উভয় লোশনের মধ্যে কালোজিরা তেলের লোশন এ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া জ্বালাপোড়া ও চুলকানি ভাব কম ছিল।
কোলেস্টেরল কমায়ঃ নিউবারি স্ট্রিট নিউট্রিশনের প্রতিষ্ঠাতা ও পুষ্টিবিদ স্কাইলার গ্রিগস বলেন, ‘কালোজিরার তেলে প্রচুর পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা আমাদের শরীরে উপকারী কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে সমস্ত স্থূল নারী প্রতিদিন তিন গ্রাম করে ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ কালোজিরার তেল খান তাদের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল খুব দ্রুত কমে যায়। আবার অন্য একটি গবেষণায় টাইপ২ ডায়াবেটিস রোগী রা প্রতিদিন ৩ গ্রাম করে বারো সপ্তাহ পর্যন্ত কালোজিরা তেল খাওয়াতে এলডিএল কোলেস্টেরল ও ট্রাই গ্লাইসেরাইড উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমতে থাকে। উঁচু মাত্রার এলডিএল কোলেস্টেরল ও ট্রাই গ্লাইসেরাইড উভয়ই হৃদ রোগের ঝুকি বাড়ায়। যা নিয়ন্ত্রনে রাখতে কালোজিরা তেল বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে।
মাথা ব্যথায়ঃ মাথা ব্যথায় কপালে ও উভয় চিবুকে, কানের পার্শ্ববর্তী স্থানে দৈনিক তিন থেকে চারবার কালোজিরার তেল মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্য ভালো রাখতেঃ মধুসহ প্রতিদিন সকালে কালো জিরার তেল খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে ও সকল রোগ মহামারী হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
হজমের সমস্যা দূরীকরণঃ হজমের সমস্যায় প্রতিদিন এক থেকে দুই চামচ কালোজিরার তেল প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার খেলে এক মাসের মধ্যে হজম শক্তি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি পেট ফাঁপা ও বদহজম ও দূর হবে।
লিভারের সুরক্ষায়ঃ লিভারের সুরক্ষায় নিয়মিত কালিজিরার তেল সেবন অনন্য ভূমিকা রাখে। লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী আফলাটক্সিন নামক বিশ ধ্বংস করে এই কালোজিরার তেল।
পারকিনসন রোগের প্রতিকারেঃ কালোজিরার তেলে থাইমোকুইনিন থাকে যা পারকিনসন ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের দেহে উৎপন্ন ডক্সিমের প্রভাব থেকে নিউরনের সুরক্ষায় কাজ করে।
কিডনির পাথর ও ব্লাডার নিরাময়ঃ কালোজিরা খুব ভালোভাবে গুঁড়ো করে মধুর সাথে মিশিয়ে দুই চামচ মিশ্রণ আধা কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন আধা কাপ তেল সহ পান করুন। এটি নিয়মিত সেবনে কিডনির পাথর ও ব্লাডার নিরাময় করবে। এছাড়াও কালোজিরার টিংচার মধুসহ দিনে তিন চারবার ১৫ ফোটা সেবন করতে পারেন।
চোখের ব্যথা দূর করতেঃ রাতে ঘুমানোর আগে চোখের উভয় পাশে ও ভ্রুতে কালোজিরা তেল মালিশ করুন এবং এক কাপ গাজরের রসের সাথে একমাস কালোজিরা তেল সেবন করুন। নিয়মিত গাজর খেয়ে ও কালোজিরা টিংচার সেবন আর তেল মালিশে চোখের ব্যথা দূর হবে ও ত্বক উজ্জ্বল করবে।
ডায়রিয়ায়ঃ মুখে খাবার স্যালাইন ও হোমিও ঔষধের পাশাপাশি এক কাপ দই ও বড় এক চামচ কালো জিরার তেল দিনে দুইবার সেবনে ডায়রিয়া নিরাময় হয়।
গ্যাস্ট্রিক বা আমাশয় নিরাময়ঃ এক চা চামচ তেল সমপরিমাণ মধুসহ দিনে ৩ বার করে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সেবন করলে গ্যাস্টিক বা আমাশয়ের সমস্যা নিরাময় হয়।
দুগ্ধদানকারী মায়ের দুধ বৃদ্ধির জন্যঃ যেসব মায়েদের বুকে পর্যাপ্ত দুধ নেই তাদের একমাত্র মহা ঔষধ হল কালোজিরা। প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে পাঁচ থেকে দশ গ্রাম কালোজিরা মিহি করে দুধের সঙ্গে নিয়মিত খেলে মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে দুধের প্রবাহ বেড়ে যাবে। এছাড়া এ সমস্যা সমাধানে কালোজিরা ভর্তা করে ভাতের সঙ্গে খেতে পারেন। অথবা এক চা চামচ কালোজিরা তেল সমপরিমাণ মধুসহ দৈনিক তিনবার করে নিয়মিত খেলে তা শতভাগ কার্যকরী হয়।
অনিয়মিত মাসিক রোধের ক্ষেত্রেঃ এক কাপ কাঁচা হলুদের রস বা সমপরিমাণ আতপ চাল ধোঁয়া পানির সাথে এক চা চামচ কালোজিরা তেল মিশিয়ে দৈনিক তিনবার করে নিয়মিত খেলে তা শতভাগ কার্যকরী হয়।
বাতের ব্যথা নিরাময়ঃ বাতের ব্যথায় আক্রান্ত স্থানে নিয়মিত কালোজিরার তেল মালিশ করলে বাতের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
জ্বর সর্দি কাশিতেঃ এক চা চামচ কালোজিরা তেলের সঙ্গে তিন চা চামচ মধু ও দই চা চামচ তুলসীপাতার রস মিশিয়ে তিন চারদিন খেলে জ্বরব্যথা সর্দি কাশি দূর হয়।
শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রোগ সারাতেঃ প্রতিদিন এক চা চামচ কালোজিরা তেল এক কাপ দুধ বা রংয়ের সাথে দৈনিক তিনবার সেবন করলে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দ্রুত উপশম হয়।
অর্শ রোগ নিরাময়ঃ এক চা চামচ মাখন ও সমপরিমাণ কালোজিরার তেল সহ প্রতিদিন খালি পেটে তিন চার সপ্তাহ খেলে অর্শ রোগ নিরাময় হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতেঃ নিয়মিত কালিজিরার তেল সেবন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সতস থাকে। এতে করে যে কোন জীবনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেহকে প্রস্তুত করে তোলে এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। এক চামচ কালোজিরা অথবা কয়েক ফোটা কালোজিরার তেল ও এক চামচ মধু সহ প্রতিদিন সেবনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত বাড়ে।
কালোজিরার তেল ব্যবহারের নিয়ম
কালোজিরার তেল ক্যাপসুল বা লিকুইড হিসেবে সেবন করা যেতে পারে। চিকিৎসকদের মতে দিনে এক থেকে দুই চা চামচ কালোজিরা তেল সেবন করা নিরাপদ। তবে শুরুর দিকে হাফ চা চামচ সেবন করা উচিত। এতে শরীর দ্রুত অ্যাডজাস্ট করতে সক্ষম হয়।
কালোজিরার তেল ব্যবহারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
কালোজিরার তেল সকল রোগের মহা ঔষধ হলেও এর রয়েছে কিছু মৃদু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও। যথাঃ
- ত্বকে জ্বালাপোড়া বা চুলকানি
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- বমি
- বমি ভাব ও পেট ফাঁপা।
কালোজিরার তেল ব্যবহারের সতর্কতা
অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে কালোজিরার তেল নিরাপদ হলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আপনি নিয়মিত কোন ঔষধ সেবন করে থাকলে ও কিডনিতে কোন সমস্যা থাকলে কালোজিরার তেল সেবনের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই তেল বিটা ব্লকার্স সহ কিছু ঔষুধের সাথে মিথষ্ক্রিয়া ঘটাতে পারে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় ও দুই বছরের কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে কালোজিরার তেল সেবন করা উচিত নয়। তবে এটির বাহ্যিক ব্যবহার করা যাবে।
বর্তমানে বাজারে যে কালোজিরার তেল পাওয়া যায় তা অধিকাংশ ই ভেজাল যুদ্ধ এবং খাওয়ার অনুপযোগী। এই ধরনের কালোজিরার তেল খেলে স্বাস্থ্যের উপকারের তুলনায় অপকার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি রয়েছে। তাই কালোজিরার তেল কেনার পূর্বে অবশ্যই খাঁটি ও ভেজাল মুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করে নিবেন।