থাইরয়েড কি? এর কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার। Thyroid in Bengali
অতি পরিচিত একটি গ্রন্থির নাম থাইরয়েড। গলার সামনের দিকে প্রজাপতি আকৃতির এই গ্রন্থিটি একটি মানুষের বৃদ্ধি, বিকাশ, শারীরবৃত্তীয় আর বিপাকীয় নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে থাকে। থাইরয়েড গ্রন্থির মিশ্রিত হরমোনের ওপর নির্ভর করে মূলত এই প্রক্রিয়া গুলো সম্পন্ন হয়। মানব শরীরে এই থাইরয়েড হরমোনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে।
নির্দিষ্ট মাত্রার থেকে যখন কম অথবা বেশি হরমোন নিঃসৃত হয় তখনই শরীরের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। আমাদের বাংলাদেশে থাইরয়েড রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ প্লাস। বলা যায় দেশের অন্য যেকোনো রোগের চাইতে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা অনেক বেশি। আর তাইতো পরিসংখ্যানের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে থাইরয়েড গ্রন্থির নানা সমস্যা অন্যতম হরমোন জনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ডায়াবেটিসের মতো ভয়াবহ রোগের পরেই থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা জনিত রোগটি অবস্থান করছে। আর সবচাইতে ভয়ংকর যে সত্যি সেটা হচ্ছে, নারীরা এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকছেন। আরো বিস্তারিত জানতে সম্পূর্ণ আর্টিকেল পড়ুন।
থাইরয়েড কি?
থাইরয়েড হলো গলার দুই পাশে থাকা একটি বিশেষ গ্রন্থী, যা আমাদের গলার সামনের দিকে অবস্থান করে। এটি আমাদের শরীরের কিছু জরুরী হরমোন উৎপাদনকারী গ্রন্থি। যার সাহায্যে আমাদের শরীরে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
যেমন: পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্রম, মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ইত্যাদি। আর তাছাড়াও থাইরয়েড হরমোনের একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্নায়ুর পরিপক্কতা অর্জন। এজন্য গর্ভকালীন সময়ে থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতার কারণে গর্ভে থাকা বাচ্চা বুদ্ধিদীপ্ত হয় না। দেখা দেয় নানা সমস্যা।
- থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ কি?
থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ হচ্ছে হরমোন সৃষ্টি করা। এটি মূলত দুই ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে।
১. ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন (T3)
২. থাইরক্সিন (T4)
মানব শরীরে যদি এই থাইরয়েড হরমোনের নিঃসরণ সঠিক মাত্রায় না হয়, তাহলে দেখা দেয় নানা সমস্যা। শরীরের থাইরয়েড হরমোন কম উৎপন্ন হলে এই সমস্যা কে চিহ্নিত করা হয় হাইপোথাইরয়েডিসম নামে। অপরদিকে বেশি উৎপন্ন হলে চিহ্নিত করা হয় হাইপারথাইরয়েডিসম নামে।
হাইপোথাইরয়েডিসম
মানব শরীরে থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম উৎপন্ন হয় এক্ষেত্রে এই সমস্যাটি হওয়ার অধিক সম্ভাবনা থাকে। যদিও বা কম হরমোন নিঃসরণের ক্ষেত্রে তেমন একটা লক্ষণ চোখে পড়ে না, তবুও যে বিষয়গুলো আপনার নজরে আসলে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার থাইরয়েড এর হাইপোথাইরয়েডিসম এর সমস্যা হয়েছে। যথাঃ
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- ত্বক রুক্ষতা
- শীত শীত অনুভব
- ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্থতা
- ভুলো মন
- অমনোযোগী
- বিষন্নতা
- পালস রেট স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যাওয়া
- পেশী এবং বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হওয়া
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত পরিমাণ রক্তক্ষরণ হওয়া।
তাই কারো শরীরে যদি হঠাৎ করে এই লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে থাইরয়েড রোগ তার শরীরে বাসা বেধেছে।
হাইপারথাইরয়েডিসম
থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় অধিক বেশি উৎপাদিত হয় এবং নিঃসরণ ঘটে তাহলে এই সমস্যাটি দেখা দেয়। আমাদের থাইরয়েড গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি। আর পিটুইটারি গ্রন্থিকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস।
আবার হাইপোথ্যালামাস থাইরয়েড রিলিজিং হরমোন নামক এক হরমোন নির্গমন করে থাকে। এই টিআরএইচ হরমোনের কাজই হচ্ছে পিটুইটারি গ্রন্থিকে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন নামক হরমোন নির্গমন করার জন্য সংকেত পাঠানো। এক কথায়, হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারি গ্রন্থি এবং থাইরয়েড গ্রন্থি একত্রিত প্রচেষ্টায় হরমোন নির্গমনের কাজ সম্পন্ন করে থাকে। তাই এর মধ্যে যেকোনো একটি অসুস্থ হয়ে পড়লে অর্থাৎ তাদের কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে হাইপারথাইরয়েডিজম সমস্যাটি উপস্থিত হয়।
এক্ষেত্রে লক্ষণ হিসেবে যেগুলো দেখা দেয়– সেগুলো হচ্ছেঃ
- হজমে গড়বড়
- অসহ্য গরমের অনুভূতি
- অতিরিক্ত ঘাম
- অস্থিরতা
- দ্রুত ওজন কমে যাওয়া
- ঘুমে অনিয়ম
- পালসেট বেড়ে যাওয়া
- দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ-বিষন্নতা বেড়ে যাওয়া
- চুল উঠে যাওয়া এবং ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া
- ত্বকের চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া
- মহিলাদের ঋতুস্রাবে অনিয়ম এবং অল্প ব্লিডিং
- হৃদস্পন্দন অধিক বেড়ে যাওয়া।
আর যদি থাইরয়েড গ্রন্থি সুস্থ থাকে এবং সঠিক মাত্রায় হরমোন নিঃসৃত হয়, তাহলে শরীরের কোন প্রকার সমস্যা দেখা দেয় না অর্থাৎ উল্লেখিত কোন লক্ষণ প্রকাশ পাবে না। এক কথায়, থাইরয়েডের কাজ হচ্ছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন সিক্রেট করা, যা শরীরের কাজকে পরিবর্তন করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে।
কারণ থাইরয়েড গ্রন্থি যে দুই ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে এই হরমোন গুলো থাইরয়েড গ্রন্থি দ্বারা সরাসরি রক্তের সিক্রেটেড হয় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ভ্রমণ করে। ফলে এই হরমোন গুলো শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়া-কলাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
থাইরয়েড গ্রন্থির গঠনগত সমস্যা
থাইরয়েডের গঠনগত সমস্যার মধ্যে রয়েছে গলগন্ড অর্থাৎ থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যাওয়া। এছাড়া থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে গোটা বা নডিউল এর সমস্যার সৃষ্টি হওয়া, পাশাপাশি ক্যান্সার।
থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যগত সমস্যা
থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা আবার স্বল্প কার্যকারিতা এটি হচ্ছে কার্যগত সমস্যা। হরমোন যদি অধিক মাত্রায় নিঃসরণ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়, খাবারে অরুচি বেড়ে যায়, ঘনঘন পায়খানা হয় এবং ওজন দ্রুত কমে যায়। অপরদিকে থাইরয়েড হরমোন যদি স্বল্পমাত্রায় নিঃসরণ হয় সেক্ষেত্রে– কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়, রক্তচাপ বেড়ে যায় ইত্যাদি।
আবার কার্যগত সমস্যার মধ্যে পড়ে ক্যান্সারও। থাইরয়েডের কোন অংশের কোষ সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেলে থাইরয়েড ক্যান্সার শরীরে বাসা বাঁধে। তাই বলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি বা এর কোন অংশ ফুলে ওঠা মানেই কিন্তু ক্যান্সার নয়। যদি থাইরয়েড ক্যান্সার হয়ে থাকে তাহলে লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে যেগুলোঃ
- গলার সম্মুখভাগ অতিরিক্ত ফুলে ওঠা
- ফোলা অংশ বেশ শক্ত হয়ে যাওয়া
- থাইরয়েডের দুই পাশে টিউমার হওয়া
- আশেপাশের লিংক নোডগুলো ফুলে ওঠা
- ওজন দ্রুত কমে যাওয়া
- খাবারে অরুচি
- গলার স্ব র মোটা হয়ে যাওয়া
- গলার স্বর ফ্রেসফেসে হয়ে যাওয়া
- শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়ে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেওয়া।
তাই শরীরে যদি এই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় তাহলে অতি দ্রুত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ বা থাইরয়েড অপারেশনে পারদর্শী এমন কোন সার্জনের শরণাপন্ন হাওয়া জরুরী।
থাইরয়েড ব্যাধির লক্ষণ কি কি?
একজন থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দেবে। সেগুলো হচ্ছেঃ
- মাসিকের সমস্যা
- মানসিক দৃঢ়তা
- পড়াশুনায় অমনোযোগী
- কৈশোর প্রাপ্তিতে বিলম্ব
- খরবতা
- বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতা
- সন্তান ধারণে অক্ষমতা
- চুল ও ত্বকের সমস্যা
- জ্বর জ্বর অনুভব
- ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্থতা
- কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা
- গর্ভধারণ করার পর গর্ভপাত হয়ে যাওয়া
- তাপমাত্রার পরিবর্তনে অসহিষ্ণুতা
- ঘাড়ের সামনে ফুলে যাওয়া
- কার্ডিয়াক তালের অনিয়ম
- ট্যাকিকার্ডিয়া অর্থাৎ উচ্চ হার্ট রেট
- এক্সো ফথালমোস
- ওজন বৃদ্ধি ও হ্রাস
- শ্বাসকষ্ট
- খাবার গিলতে অসুবিধা
- কণ্ঠস্বরের বিকৃতি
- মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- শরীর মুটিয়ে যাওয়া
- ভ্রু পড়ে যাওয়া
- এবং মেধা শক্তির পরিবর্তন অর্থাৎ ভুলে যাওয়ার সমস্যা সহ প্রভৃতি।
থাইরয়েডজনিত রোগের প্রকারভেদ
থাইরয়েড জনিত ব্যাধিগুলো তিন ধরনের হয়ে থাকে। যথা:
- ১. অ-বিষাক্ত অর্থাৎ সরল গলগন্ড
- ২. বিষাক্ত গলগন্ড
- ৩.নিউপ্লাস্টিক গলগন্ড
সরল গলগন্ড: এটি খুবই পরিচিত একটি রোগ। থাইরয়েড গ্রন্থির এই সমস্যার কারণে শরীরের কার্যক্রমে কোনো পরিবর্তন আসে না। এটি একটি ইউথাইরয়েড অবস্থায় থাকে। সরল গলগন্ডের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে– মাল্টিনোডুলার গলগন্ড, কলয়েড গলগন্ড, ডিফিউজ হাইপার প্লাস্টিক। এর মধ্যে ডিফিউস হাইপারপ্লাসটিক হচ্ছে সবচেয়ে সাধারণ।
বিষাক্ত গলগন্ড: এই সমস্যাটি খুব একটা জটিল হয়ে উঠতে পারে আবার নাও পারে। এটি মূলত টি-থ্রি এবং টি-ফোর এর বর্ধিত সিক্রেটেড এর সাথে যুক্ত। বিষাক্ত গলগন্ডের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে– প্লামার, কবর, এবং বিষাক্ত নির্জন নোডুল।
নিওপ্লাস্টিক গলগন্ড: থাইরয়েড ক্যান্সার জনিত সমস্যার বৃদ্ধির কারণে এটি হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে সৌম্য, অপরটি হচ্ছে ম্যালিগন্যান্ট।
থাইরয়েড সমস্যার কারণ কি | কি কি কারণে থাইরয়েড রোগ হয়ে থাকে?
থাইরয়েড কি? থাইরয়েডের রোগ কি কি এ সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যে জানলাম। কিন্তু থাইরয়েড সমস্যার কারণ কি? এ সম্পর্কে থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এ.কে.এম ফজলুল বারী চারটি কারণ উপস্থাপন করেছেন। থাইরয়েড সমস্যার জন্য প্রধানত এই চারটি কারণ কে দায়ী করা হচ্ছে।
১. আয়োডিনের অভাব
শরীরে পরিমাণ এর চাইতে আয়োডিনের স্বল্পতার। এটি অবশ্য সবচেয়ে সাধারণ একটি কারণ। আর আমাদের কমবেশি সকলেরই জানা। আয়োডিনের অভাবে যে সমস্যাটি দেখা দেয় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হল গয়টার। গয়টার বলতে গলার নিচের দিকে ফুলে যাওয়াকে বোঝানো হয়। আমাদের বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় সকলের আয়োডিনের অভাবে এই সমস্যাটি অধিক হারে হয়ে থাকে। তবে হ্যাঁ, এর পাশাপাশি আয়োডিনের অভাবের কারণে বিভিন্ন বামনত্ব রোগ বেড়ে যাচ্ছে বর্তমানে, সাথে মানসিক-শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং জন্ম নিচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ সন্তান।
২. বংশগত
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে জেনেটিক অর্থাৎ বংশের কথা উঠে এসেছে। যদি বাবা-মা, দাদা-ফুপু অথবা পূর্বপুরুষদের থাইরয়েড গ্রন্থির কোন রকমের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সেটা বংশপরম্পরায় বর্তমান প্রজন্মেরও হতে পারে।
৩. রেডিও আয়োডিন সেবন
থাইরয়েডের চিকিৎসার জন্য এমন অনেকেই রয়েছে যারা রেডিও আয়োডিন খেয়ে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটা প্রমাণিত হয়েছে, যদি কেউ রেডিও আয়োডিন খেয়ে থাকে তাহলে তার জটিল থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৪. সার্জারি
চতুর্থ কারণ হিসেবে রয়েছে সার্জারি। হাইপারথাইরয়েডিজম, গয়টার, নডিউল এবং টিউমার ইত্যাদি যেকোনো একটি ক্ষেত্রে যদি অপারেশন করা হয়ে থাকে তাহলে সেই সমস্যা থেকেও থাইরয়েডের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তবে ৭০ ভাগের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থির অর্ধেক কেটে ফেললেও রোগী তার বাকি অর্ধেক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়, কোন রকমের সমস্যা ছাড়াই।
থাইরয়েড এর কারণে কি কি সমস্যা হয়?
থাইরয়েড গ্রন্থির প্রধান কাজ আয়োডিন সংবলিত হরমোন তৈরি। ট্রিথাইরোনিন (T3) ও থাইরক্সিন (T4) হলো আয়োডিন সমৃদ্ধ হরমোন। আয়োডিনের তিনটি অণু থাকায় এর নামকরণ T3 করা হয়েছে। অপরদিকে T4 এ চার আয়োডিন অণু থাকে। এছাড়া পেপ্টাইড হরমোন ক্যালসিটোনিনও থাইরয়েড গ্রন্থিতে তৈরি হয়।
কিন্তু কোন কারণে যদি এটি সঠিকভাবে তৈরিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় তাহলে দেখা দেয় থাইরয়েডের নানা সমস্যা। আর নারীদের ক্ষেত্রে এটি পুরুষদের তুলনায় প্রায় আট গুণ বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম হয়। যেসব কারণে মূলত থাইরয়েডের যে যে সমস্যা দেখা দেয়ঃ
- থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হওয়ার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অটোইমিউন বা ইমিউন ব্যবস্থার গোলমালের জন্য থাইরয়েড কোষ বিনষ্ট হয়ে যায়।
- থাইরয়েডের অস্ত্রোপচার, রেডিয়েশন, বিভিন্ন ঔষধের ইফেক্ট, প্রদাহ ইত্যাদি কারণেও থাইরয়েড হরমোনের কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
- থাইরক্সিন হরমোন অতিরিক্ত পরিমাণে নিঃসৃত হওয়ার কারণে অটো ইমিউন সমস্যা দেখা দেয়।
- থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ অর্থাৎ থাইরয়েডাইটিস হয় এবং গ্রন্থিতে ক্যান্সার ও টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- জেনেটিক সংবেদনশীলতা ও দীর্ঘস্থায়ী সহজ গলগন্ড/হরমোনের নানা সমস্যার কারণে এটা ক্যান্সারের রূপ ধারণ করতে পারে।
- বিরল কারণ হিসেবে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনের কারণে বা অন্যান্য রোগের গৌণ মাধ্যমকে কেন্দ্র করে থাইরয়েডের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
- থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে ইনফেকশন হয়।
তাই এই সকল বিষয়গুলো থেকে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
থাইরয়েডজনিত সমস্যা পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি
শরীরে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিয়েছে বেশ কিছু উপসর্গ মিলে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করাটা খুবই জরুরী একটি বিষয়। তাই এজন্য দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা অতীব জরুরি। থাইরয়েড এর কারণে যদি ক্যান্সার জনিত কোন সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ পায় তাহলে সুঁই দিয়ে গলা থেকে টিস্যু নিয়ে সার্জারি করে বায়পসি করার দরকার পড়তে পারে।
আবার রক্তে ফ্রি থাইরক্সিন এবং থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন পরীক্ষা করেও রোগ সনাক্ত করা যায়। পাশাপাশি থাইরয়েডের নানা এন্টি বডি, গলার আল্ট্রাসনোগ্রাফি রেডিও আয়োডিন আপটেকও পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।
থাইরয়েড রোগ থেকে পরিত্রাণের উপায়
যেকোনো রোগের কবল থেকে বাঁচতে চিকিৎসার বিকল্প নেই। চিকিৎসা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে সেই সাথে মেনে চলতে হবে কিছু নিয়ম নীতি। কিন্তু থাইরয়েড রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে থাকে, রোগীর শরীরের কন্ডিশন এবং রোগের ধরনের উপর। অন্য কোন রোগের কবল থেকে মুক্তি পেতে শুধুমাত্র কিছু প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সুস্থতা কাম্য করা যায়। কিন্তু থাইরয়েড রোগের চিকিৎসার প্রধান লাইন হলো চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, হরমোন এবং বিকিরণ।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, যদি থাইরয়েড রোগে কেউ আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে সারা জীবন ওষুধ খেতে হয়। এমন একটা লম্বা সময় চিকিৎসা নিতে হয় যা সত্যিই বিরক্তিকর এবং কষ্টকর। তবে একটা দিক থেকে অনেক সুবিধা হচ্ছে, থাইরয়েডের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ঔষধ গুলোর মূল্য খুবই কম। সেই সাথে ফুড সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যায়।
তবে প্রেগনেন্সির সময়ে কেউ যদি থাইরয়েডের রোগে ভুগে থাকেন তাহলে সেক্ষেত্রে ট্যাবলেট এর পরিমাণ একটু বেশি পড়ে যায়। তবে প্রত্যেকটা ঔষধই সহজলভ্য। গ্রাম থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই এগুলো খুব সহজেই পাওয়া যায়। আপনার শরীরে যদি বিষাক্ত গলগন্ড বাসা বাঁধে তাহলে তেজস্ক্রিয় আয়োডিন ট্যাবলেট সেবন করতে হতে পারে আর সহজ গলগন্ড রোগে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থতা লাভ করা যায়। যদি থাইরয়েড এর নিওপ্লাজম সমস্যায় আক্রান্ত হন তাহলে, এক্ষেত্রে উচ্চমাত্রায় থাইরক্সিন টি এস এইচ সিক্রেট এর জন্য তেজস্ক্রিয় আয়োডিন সেবন করতে হবে। আবার সেকেন্ডারি দের জন্য বিকিরণ থেরাপি কেমোথেরাপিও গ্রহণ করতে হতে পারে।
থাইরয়েড ক্যান্সারের চিকিৎসা
বর্তমানে চিকিৎসা প্রযুক্তি এখন অনেক বেশি উন্নত। আর এখন ক্যান্সারের কিছু চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে বেশ কিছু মাধ্যম। সেগুলো হচ্ছে:
- ডায়াগনোসিস
- আল্ট্রাসাউন্ড
- এসএনএসি
বিশেষ করে- আল্টাসাউন্ড যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিতে সক্ষম হয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে খুব সহজেই শনাক্ত করা যায় কোনো রোগীর শরীরে থাইরয়েড ক্যান্সার হয়েছে কিনা? শুধু এটুকুই নয়, ক্যান্সারের ভয়াবহতা কতটুকু? এখন সেই ক্যান্সার কি পর্যায়ে রয়েছে? ইত্যাদি এ বিষয়েও সুস্পষ্ট রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব হয় ডায়াগনোসিস ও আল্টাসাউন্ড এর মাধ্যমে।
পাশাপাশি এ্যালাসটোসস্ক্যান এর মাধ্যমে রং দেখে টিস্যু এলাস্টিসিটি আলাদা করে বোঝা যায় থাইরয়েড ক্যান্সার শরীরে বাসা বেঁধেছে কিনা। পাশাপাশি এসএনএসির পদ্ধতি অবলম্বন করে বোঝা যায় থাইরয়েড গ্রন্থি ভালো আছে কতটুকু আর মন্দ আছে কতটুকু। যদি কোন সমস্যা থেকেও থাকে তাহলে এর সাহায্যে কোন প্রকার সুই ফোটানো ছাড়া এবং রক্তপাত ছাড়াই চিকিৎসা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়।
থাইরয়েড রোগের সমাধানে খাবারের ভূমিকা
আমাদের শরীরে যখন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয় তখনই শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে। মূলত অনিয়ম জীবন যাপন ও খাদ্য পান থাইরয়েডের সমস্যার অন্যতম কারণ। এর মানে হচ্ছে, আপনি যদি আপনার জীবন যাপন সম্পর্কে সচেতন না হোন এবং খাদ্য গ্রহণে বেখেয়ালি হন তাহলে আপনার পক্ষে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই থাইরয়েড রোগে যদি কেউ আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে সেটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ডায়েট চার্ট ফলো করা অতি আবশ্যক।
পুষ্টিবিদরা বলেছেন যাদের শরীরে থাইরয়েড রোগ রয়েছে তাদেরকে অবশ্যই কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত।। যথা:
- প্যাকেটজাত খাবার বা প্রসেস খাবার থেকে সর্বদা দূরে থাকা। যেমন: বিস্কুট, চিপস, মাল্টি গ্রেইন ইত্যাদি প্রভৃতি প্রক্রিয়াজাত খাবার। কারণ থাইরয়েডের ক্ষেত্রে লবণ ও সোডিয়াম খুবই ক্ষতিকর উপাদান। আর প্যাকেটজাত খাবারগুলোতে প্রিজারভেটিভ, লবণ ও সোডিয়াম দেওয়া থাকে।
- থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে হরমোন তৈরিতে বাধা প্রদান করে থাকে চর্বি। তাই যাদের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি রয়েছে তাদের উচিত ফাস্টফুড এড়িয়ে চলা। শুধু তাই নয় এর পাশাপাশি মাখন, তেলে ভাজা যে কোন খাবার পরিহার করা জরুরী।
- যাদের থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে তাদের মাল্টিগ্রেইন এর পরিবর্তে খাওয়া উচিত হোল গ্রেইন। কারণ এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট এবং আয়োডিন, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
- দই, বাদাম, চিজ, ডিম, মাছ, মাংস, ডাল এই খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন ও প্রোটিন রয়েছে। আর শরীরে আয়োডি ন এবং প্রোটিন মিশে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয়। এজন্য অবশ্যই এই খাবারগুলো থাইরয়েড রোগীদের জন্য উপকারী।
থাইরয়েড রোগীদের ডায়েট চার্ট
থাইরয়েড রোগে ভোগা রোগীদের জন্য খাবারের মেনুতে অবশ্যই যে খাবারগুলো রাখতে।
১. আয়োডিনযুক্ত খাবার
২. তামা এবং লোহ যুক্ত খাবার
৩. ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাবার
কারণ থাইরয়েড পীড়িত রোগীদের খাদ্যে আয়োডিনের মাত্রা যত উপযুক্ত হওয়া উচিত। আয়োডিনের অভাবেই থাইরয়েড জনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়। অপরদিকে তামা এবং লোহা যুক্ত খাবার থাইরয়েড রোগীদের জন্য যথেষ্ট লাভজনক। কারণ এতে থাকা পুষ্টি উপাদান থাইরয়েড গ্রন্থির ক্রিয়া ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই নিয়মিত কাজুবাদাম, সূর্যমুখীর বীজ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা থাইরয়েড রোগীদের জন্য উত্তম। পনির ও কাঁচকলা পাশাপাশি সবুজ লঙ্কার সাথে টমেটো খাওয়া উচিত। কারণ এই খাবারগুলো থাইরয়েড গ্রন্থির জন্য অত্যন্ত লাভজনক। থাইরয়েড রোগীদের এসবের পাশাপাশি ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবারের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সাথে আইসক্রিম এবং দই, গরুর দুধ, এই খাবারগুলো নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস করে তোলা উচিত। সেই সাথে আরেকটি বিশেষ ব্যবহারকারী জিনিস হচ্ছে নারকেল তেল। নারকেল তেলের ব্যবহার থাইরয়েড গ্রন্থের সক্রিয়তা বাড়ায়। তাই এটি ব্যবহারের পাশাপাশি খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করলে উপকার পাওয়া যায়।
থাইরয়েডে ওষুধ খাওয়ার নিয়ম
অবশ্যই যে কোন রোগের জন্য ঔষধ সেবন করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। তবে থাইরয়েডের জন্য ট্যাবলেট সকালে খালি পেটে নেওয়া যেতে পারে। এর বাইরে কিছু লোক খাবারের ৫০ মিনিট আগে পিল সেবন করে থাকে।
সতর্কতাঃ যেহেতু থাইরয়েড বর্তমান সময়ে খুবই জোরালো একটি অসুখ, তাই কিছু লক্ষণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভালো কোন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন এবং নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনযাপন করুন আর খাবারের দিকে নজর দিন। যেহেতু আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েডের সমস্যা হয় তাই শরীরের পর্যাপ্ত আয়োজনের যোগান দিতে পর্যাপ্ত আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার খান।