ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা ২০২২
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশে বহুল পরিচিত কিছু রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। এর কারণ হিসেবে মনে করা হয় যে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ডায়াবেটিস হলো পৃথিবীর একমাত্র অসংক্রামক রোগ যা সারা পৃথিবীব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
অনেকে ডায়াবেটিসকে বংশগত রোগ মনে করলেও এর পাশাপাশি বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে। তবে সময় মত এই রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা গ্রহণ করলে খুব সহজে মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
তবে বলা হয়ে থাকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর তিনটি ‘ ডি, মেনে চলা খুবই জরুরী।
- প্রথমত ডায়েট বা পরিমিত খাবার
- ড্রাগ বা ঔষধ এবং
- ডিসিপ্লিন বা নিয়মানুবর্তিতা।
আজকে আমরা একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে বিস্তারিত জানব।
ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস এক ধরনের অসংক্রামক রোগ যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সিস্টেম এর কার্যকারিতায় বাধা প্রদান করে। মানব দেহ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে অগ্নাশয় ইনসুলিন উৎপন্ন করতে পারে না। অনেক সময় শরীরের ইনসুলিন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আমরা নিয়মিত আরজে খাবার গ্রহণ করি সেই খাবার থেকে উৎপন্ন শর্করা গ্লুকোজে পরিণত হয়। আমাদের শরীরে উৎপাদিত ইনসুলিন এই গ্লুকোজ গ্রহণ করে শরীরে জ্বালানির চাহিদা পূরণ করে থাকে। কিন্তু ইনসুলিন উৎপাদন ক্ষমতার বিনষ্ট হবার কারণে আমাদের শরীরে যখন গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে তখন ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদঃ
সারা পৃথিবীব্যাপী এখন পর্যন্ত চার ধরনের ডায়াবেটিস আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো হলো:
- টাইপ- ১
- টাইপ- ২
- গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস
- অন্যান্য ডায়াবেটিস।
টাইপ- ১ ডায়াবেটিসঃ এধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন হবার ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এদের শরীরে যদি নিয়মিত ইনসুলিন দেওয়া না হয় তবে যেকোনো সময় এই রোগী মারা যেতে পারে। সুতরাং টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ইনসুলিন নেওয়া বাধ্যতামূলক। পৃথিবীর প্রায় ৪ থেকে ৫ শতাংশ মানুষ টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
টাইপ- ২ ডায়াবেটিসঃ এই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন হওয়া সত্বেও সেটি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে শরীরে চিনির পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকে। সারা পৃথিবীর ডায়াবেটিস রোগীদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ টাইপ টু ডায়াবেটিস আক্রান্ত।
গেস্টেশনাল ডায়াবেটিসঃ গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা শরীরের ইনসুলিন এর কার্যকারিতায় বাধা প্রদান করে। এর ফলে শরীরে চিনির পরিমাণ বাড়তে থাকে। যদিও সন্তান জন্মদানের পর অনেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু গর্ভবতী মহিলাদের প্রায় ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ রোগীদের পরবর্তী জীবনে গেস্টেশনাল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
অন্যান্য ডায়াবেটিসঃ শরীরে যে কোন কারনে গ্লুকোজের পরিমাণ অত্যন্ত বেড়ে যায় যার ফলে ঘন ঘন প্রসাব হয় এবং তৃষ্ণা পায়। ডাইরেকটিক হরমোন নিঃসরণ এর ফলে শরীরের প্রস্রাবের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এক থেকে দুই শতাংশ রোগীরা এই ধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্ত।
আরও পড়ুনঃ এলার্জি জাতীয় খাবার গুলো কী কী ?
মানবদেহে ডায়াবেটিস এর প্রভাব
যেহেতু ডায়াবেটিসের কারণে ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না এবং শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়তে থাকে সেক্ষেত্রে এই গ্লুকোজ শরীরের রক্তে জমতে শুরু করে। রক্তে অতিরিক্ত চিনি জমা হবার ফলে শরীরে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো হলো:
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া।
- শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করা।
- গলা শুকিয়ে যাওয়া।
- পা পচে যাওয়া।
- শরীরে ঘা হলে কিংবা কাটাছেঁড়া হলে সহজে না শুকনো।
- স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা হওয়া।
- রক্তনালী পচে যাওয়া।
- শরীরের ওজনের তারতম্য হওয়া।
- শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া।
তাছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে স্ট্রোক এবং মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা ২০২২
ডায়াবেটিস এমন এক ধরনের মারাত্মক রোগ যা সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা যায় না। তবে সুস্থ জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম, ঔষধ সেবন, এবং সুষম খাদ্য সেবন এর মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকায় শর্করা জাতীয় খাবার যথাসম্ভব কম খেতে হবে। গ্লুকোজের মাত্রা কম থাকে এমন সব খাবার যেমন গমের আটার রুটি শাকসবজি লাল চালের ভাত বাদাম কলাই জাতীয় খাদ্য ছোলা বুট ইত্যাদি বেশি বেশি খেতে হবে। এসকল খাবারগুলো শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা ধীরগতিতে বৃদ্ধি করে। তাহলে চলুন জেনে নেই এমন কিছু খাবার সম্পর্কে যা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী।
দুধঃ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য দুধ অত্যান্ত পুষ্টিকর একটি খাবার। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর অন্যতম উৎস হল দুধ। যা একজন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী খাবার। তাই সকালের নাস্তায় আপনি রাখতে পারেন এই উপাদেয় খাবারটি। অনেক সময় দুধ খেলে পেটে গ্যাস হয় সে ক্ষেত্রে আপনি দুধের পরিবর্তে দুধের ফ্যাট অংশটি ছাড়া টক দই বা অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার খেতে পারেন।
খেজুরঃ খেজুরের প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যুক্ত থাকে তাই ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এটা অত্যন্ত উপকারী। এছাড়াও আঙ্গুর কমলা লেবু ও ফুলকপির তুলনায় খেজুরের অত্যাধিক পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। যার ফলে খেজুর ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের ঔষধ হিসেবে কাজ করে।
মটরশুটিঃ মটরশুঁটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ গ্রামের মতো মটরশুটি খেলে হৃদরোগ ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগের ঝুঁকি কমায়। তাই একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মটরশুটি রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তুলসীঃ তুলসী কে বলা হয় ডায়াবেটিস রোগের ইনসুলিন। খালি পেটে তুলসী পাতার রস পান করলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
তিসিঃ তিসি বীজ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। যাকে ইংরেজিতে ফ্লেক্সসিড বলা হয়। তিসি বীজে ফাইবার ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ এ ফ্যাটি এসিড থাকে। যা রক্তে চিনির মাত্রা কমায় এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন দুই গ্লাস পানিতে ৩ চা চামচ তিসি বীজ গুঁড়া মিশিয়ে পান করলে উপকার পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার তালিকা
শর্করা জাতীয় খাবার রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তাই এই জাতীয় খাবার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ কারণে ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকায় শর্করা জাতীয় খাবার কম রাখতে হবে। চিনি, মিষ্টি, বেশি ছাটা চালের ভাত, ময়দার রুটি জাতীয় খাবার রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি করে তাই এই খাবার গুলো খাওয়া বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে মোট ক্যালোরির ২০% আসবে আমিষ থেকে, ৩০% ফ্যাট থেকে এবং ৫০% আসবে শর্করা থেকে।
ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েট চার্টঃ
ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর একমাত্র ঔষধ হলো খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন এর অভ্যাস পরিবর্তন করা। তুলনামূলক কম গ্লুকোজ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিদিন গৃহীত ক্যালরির দিকে লক্ষ রাখা অত্যন্ত জরুরী। একজন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য প্রতিদিন ১৬০০ ক্যালরির একটি খাদ্য তালিকা দেওয়া হলঃ
সকালের নাস্তা (সকাল ৭.৩০ টা–৮ টা) | দুপুরের খাবার (দুপুর ১.৩০ টা–২ টা) | বিকেলের নাস্তা (বিকেল ৫.৩০ টা–৬ টা) | রাতের খাবার (রাত ৯ টা–৯.৩০ টা |
১।রুটিঃ ১টা গমের আটার রুটি (মিডিয়াম) | ১।ভাতঃ দেড় কাপ ভাত | ১।সিজনাল ফলঃ পছন্দমত ১ সারভিং সিজনাল ফল | ১।রুটি অথবা ভাতঃ ১/২ কাপ ভাত অথবা ১ টা আটার রুটি |
২।দুধঃ ১ গ্লাস ফ্যাট ছাড়া দুধ বা স্কিম মিল্ক | ২।মাছ বা মাংশঃ ৬০ গ্রাম পরিমাণ রান্না করা মাছ বা মাংস (ফ্যাট ছাড়া) | ২।বাদাম, বুট এবং কলাই জাতীয় খাদ্যঃ ১/৪ কাপ বাদাম বা বুট বা কলাই জাতীয় খাদ্য | ২।মাছ অথবা মাংসঃ ৬০ গ্রাম পরিমাণ রান্না করা মাছ বা মাংস (ফ্যাট ছাড়া) |
৩।ডিমঃ ১ টা মুরগী অথবা হাঁসের ডিম (সিদ্ধ অথবা ভাঁজি) | ৩।শাক সবজিঃ ১ কাপ পাতা যুক্ত শাক খাকবে অবশ্যই, বাকী দেড় কাপ অন্যান্য সবজি | ৩।শাক সবজিঃ কাপ পাতা যুক্ত শাক খাকবে অবশ্যই, বাকী আধা কাপ অন্যান্য সবজি | |
৪।শাক সবজিঃ ১ কাপ পাতা যুক্ত শাক বা ১/২ কাপ সবজি | ৪।ডালঃ ১ কাপ মাঝারি ঘন ডাল | ৪।সিজনাল ফলঃ ১ সারভিং সিজনাল ফল |
ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়াম
রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণে ব্যায়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত সারা বছর নিয়মিত হাঁটা, জগিং ইত্যাদি করে থাকেন। ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়াম গুলোর মধ্যে সবচেয়ে সহজ হলো হাটা। দিনের যেকোনো সময় হাঁটা যায়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একজন ব্যাক্তি সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন ৩০ মিনিট করে হাঁটতে হবে। এছাড়াও ট্রেডমিলে হাঁটা বা দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, সাইক্লিং, দড়ি লাফ ইত্যাদি ব্যায়ামগুলো করতে পারেন।
প্রতিরোধ সব সময় প্রতিকারের চেয়ে ভালো। ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত ওজন। ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। গবেষণায় দেখা গেছে জীবনধারার পরিবর্তন, সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস ও নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে এ রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
Source: