মেয়েদের অতিরিক্ত সাদা স্রাব বন্ধ করার উপায়

সাদা স্রাব কী?

মেয়েদের সাধারণ শারীরিক সমস্যা গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হলো সাদা স্রাব বা লিউকোরিয়া। তবে এই সমস্যার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে। পিরিয়ডের বিভিন্ন সময়ে সাদা স্রাব হতে পারে। কিন্তু যদি এটি অতিরিক্ত পরিমাণে দেখা দেয় তবে অবশ্যই এই ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।

Ask Question
সাদা স্রাব বন্ধ করার উপায়

সাদা স্রাব দেখতে কেমন?

অনেকেই বুঝতে পারেন না যে, সাদাস্রাব আসলে দেখতে কেমন। স্বাভাবিকভাবে মাসিক চক্রের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যোনির ভেতর থেকে সাদা রঙের হালকা পিচ্ছিল তরল বের হয়ে আসতে পারে। তবে বিভিন্ন কারণে এই রং সাদা না হয়ে অন্যান্য রকমের ও হতে পারে। সাদা স্রাবের রং এর উপর ভিত্তি করে আসলে বোঝা যায় যে এটি আপনার জন্য কতটা ক্ষতিকর।

সাদাপিরিওডের শুরুর দিকে কিংবা শেষের দিকে সাদা রঙের তরল দেখা যেতে পারে। এর সাথে সাথে হালকা চুলকানি থাকতে পারে। কিন্তু এটি ভয়ের কিছু নয়। 
পরিষ্কার তরলমাসের যেকোনো সময় পরিষ্কার তরলের মতো স্রাব যেতে পারে। এটা একজন সুস্থ মহিলার জন্য সম্পুর্ণ স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া
বাদামি বা রক্তাক্তপিরিয়ড এর শেষের দিকে যদি বাদামি কিংবা লাল রঙের সাদাস্রাব দেখা যায় তবে সেটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কারণ অনেক সময় মাসিক দেরিতে শেষ হবার কারণে তরলের রং রক্তের মত হয়ে বের হয়ে আসে
গাঢ় পরিষ্কারপরিষ্কার রঙের সাদা স্রাব যদি দুই আঙ্গুল দিয়ে অনেক বেশি প্রসারিত করা যায় তাহলে বুঝতে হবে যে ডিম্বস্ফুটন সংঘটিত হয়েছে। এটি স্বাভাবিক সাদাস্রাব হিসেবেই ধরা হয়।
হলুদ গন্ধ যুক্তসাদা স্রাবের রং যদি কখনো হলুদ কিংবা সবুজ দেখা যায় তবে সেটি শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ ধরনের সাদাস্রাব এর সাথে বাজে একটা গন্ধ আসতে পারে। এরকম দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সাদা স্রাবের রং

সাদা স্রাবের লক্ষণ

মাসের বেশিরভাগ সময় স্বাভাবিক সাদাস্রাব হয়ে থাকে। কিন্তু ও যদি সাদা স্রাব এর পাশাপাশি কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায় তবে বুঝতে হবে যে এটি শরীরের জন্য খারাপ প্রভাব ফেলছে। 

  • যোনিতে ইস্ট কিংবা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে।
  • দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব নিঃসরণ হয়। 
  • অতিরিক্ত সাদা স্রাব এর কারণে কোমর ব্যথা কিংবা হাত পায়ে ব্যথা শুরু হয়।
  • তলপেটে ভারী অনুভূত হয়।
  • শরীর প্রচন্ড দুর্বল হয়ে যায়।
  • সংক্রমণ জনিত রোগে আক্রান্ত হলে অনেক সময় অতিরিক্ত সাদাস্রাব হয়।
  • হজমের সমস্যা দেখা দেয়।
  • যোনিতে জ্বালা পোড়া করে এবং অতিরিক্ত চুলকায়।
  • শরীর বিশেষ করে মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়।
  • চোখের নিচে কালো দাগ বেড়ে যায় এবং চোখ গর্তের ভেতরে ঢুকে যায়।
  • সহবাস করার সময় যোনিতে জ্বালা পোড়া করে।

আরো পড়ুনঃ মাসিক মিস হওয়ার কত দিন পর প্রেগন্যান্ট বোঝা যায়

মেয়েদের সাদা স্রাব কেন হয়?

অতিরিক্ত সাদা স্রাব হয়ে থাকে মেয়েদের শারীরিক অন্যান্য সমস্যার কারণে। যে সকল কারণে সাদাস্রাব এর পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে সেগুলো হলোঃ

  • পুষ্টির অভাবঃ শরীরে পুষ্টির অভাব হলে সাদাস্রাব এর পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে এটি দেখা যায়। 
  • মানসিক চাপঃ মানসিক অশান্তি আমাদের শরীরে অনেক ধরনের রোগের সৃষ্টি করে থাকে। এগুলোর মধ্যে সাদা স্রাব বিশেষত মেয়েদের জন্য অন্যতম। মানসিক অশান্তির কারণ এ অতিরিক্ত সাদা স্রাব হতে পারে।
  • কৃমির সংক্রমণঃ কৃমি মূলত আমাদের শরীরে গ্রহণকৃত পুষ্টির অর্ধেক শোষণ করে থাকে। এর ফলে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলেও শরীরের পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। এতে করে সাদাস্রাব এর সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
  • ইমারজেন্সি পিলঃ শারীরিক সমস্যার উপর ভিত্তি করে অনেক মেয়েদের ইমার্জেন্সি পিল কিংবা জন্ম বিরতিকরণ পিল সেবনের কারণে অতিরিক্ত সাদা স্রাব হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
  • অপরিচ্ছন্নতাঃ অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্নতা যেমন বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে তেমনি এর থেকে সাদাস্রাবের ও সৃষ্টি হয়ে থাকে। তাছাড়া অনেক সময় সেতসেতে কাপড় পরিধান করলে এই সমস্যা দেখা যায়।

আরো পড়ূনঃ নিয়মিত মাসিক হওয়ার প্রাকৃতিক উপায়

সাদা স্রাব এর ক্ষতিকর দিক

অতিরিক্ত সাদা স্রাব এর ভালো কোনো দিক নেই। এটি সবদিক থেকে শরীরের ক্ষতিসাধন করে থাকে। এর ক্ষতিকর দিকগুলো হলোঃ

  • শরীর দুর্বল হয়ে যায়
  • ওজন কমে যায়
  • মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হয়
  • কোন কাজে মন বসে না
  • সব সময় নিজেকে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়।
  • সময়মতো চিকিৎসা না করলে বড় ধরনের যৌন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • এর থেকে যোনি ক্যান্সার হতে পারে। 

সাদা স্রাব এর চিকিৎসা

সাদা স্রাবের কিছু হোমিও ঔষধ বাজারে পাওয়া যায় যেগুলো এ ক্ষেত্রে অনেকটা কার্যকরী। যেমন: লিউকোরিয়া, লিউকোরি়ন ইত্যাদি। তবে যেকোনো ধরনের ঔষধ খাবার পূর্বে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

মেয়েদের অতিরিক্ত সাদা স্রাব বন্ধ করার উপায়

মেয়েদের সাদাস্রাব এর মত সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হল এর প্রতিকার করা। যে সকল কারণে সাদা স্রাব হয়ে থাকে সেগুলো খুজে বের করে পরিহার করতে পারলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে নিজের উপায়গুলো অবলম্বন করে দেখতে পারেন-

  • সব সময় যথাসম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং শুকনো কাপড় চোপড় পরিধান করতে হবে।
  • অতিরিক্ত ভাজাপোড়া এবং মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া চলবে না।
  • সাদাস্রাবের সময় যৌন মিলন থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে।
  • সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
  • আন্ডারওয়ার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই শতভাগ সুতির কাপড় বাছাই করতে হবে।
  • নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
  • পিরিয়ডের সময় অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করা যাবে না। বাজারে অনুমোদিত প্যাড ব্যবহার করতে হবে।
  • যৌন মিলন শেষে যোনি পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। 
  • অতিরিক্ত টাইট কাপড় চোপড় পরিধান করা যাবে না। 
  • অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং খাদ্য অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি এবং ফলমূল খেতে হবে। 

সাদা স্রাব এর ঘরোয়া ঔষধ

শুরুর দিকে সাদা স্রাবের সমস্যা থেকে ঘরোয়া কিছু ঔষধ সেবনের মাধ্যমেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে এটি যদি অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায় সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যে সকল ঘরোয়া উপায় আপনার সাদাস্রাব এর সমস্যার সমাধান করতে পারেন-

  • ঢেঁড়স: দইয়ের সাথে যদি সিদ্ধ ঢেঁড়স মিশিয়ে খাওয়া হয় তবে অতিরিক্ত সাদাস্রাব এর সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে দই ছাড়াও আপনি শুধু সিদ্ধ ঢেঁড়স চিবিয়ে খেতে পারেন।
  • তুলসী: সর্দি কাশির পাশাপাশি তুলসী সাদা স্রাব দূর করতেও সহায়তা করে। তুলসী পাতা পানিতে সেদ্ধ করে সেই পানির সাথে অল্প একটু মধু মিশিয়ে প্রতিদিন দুইবার করে সেবন করুন। এতে করে ভালো ফল পাবেন।
  • আমলকি: ভিটামিন সি এর অন্যতম একটি উৎস হল আমলকি। আমলকি কাঁচা, গুড়া করে কিংবা মোরব্বা বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এতে করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রচুর পরিমানে বেড়ে যায় এবং সাদা স্রাব বন্ধ করতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • মেথি: ৫০০ মিলিগ্রাম পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম মেথি বীজ দিয়ে পানি অর্ধেক শুখিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সিদ্ধ করে নিন। এরপর সেই পানি ঠান্ডা করে নিয়মিত পান করুন। এতে উপকার পাওয়া যায়।
  • ধনিয়া: প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে এক কাপ পানিতে কিছু ধনিয়া ভিজিয়ে রাখুন এবং সকাল বেলায় উঠে ছেকে সেই পানি পান করুন। সাদা স্রাব দূর করার এটি অন্যতম একটি সহজ উপায়।
  • পেয়ারা পাতা: ৫০০ মিলিগ্রাম পানিতে কিছু পেয়ারা পাতা দিয়ে ভালোভাবে সিদ্ধ করে নিন। এরপর সেই পানি ঠান্ডা করে নিয়মিত পান করুন। এতে সাদাস্রাব কমে যাবার পাশাপাশি যোনির চুলকানি ও কমে যাবে।
  • ভাতের মাড়: সাদাস্রাব দূর করতে ভাতের মাড় অত্যন্ত কার্যকরী একটি সমাধান। নিয়মিত ভাতের মাড় পান করলে সাদাস্রাব এর সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

 সারকথা

পরিশেষে বলা যায় যে, সাদা স্রাব দূর করতে ওষুধের চেয়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হলো প্রতিকারের উপায়গুলি অবলম্বন করা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করলে আশা করা যায় সাদাস্রাবের সমস্যা নিয়ে কখনো ঔষধ সেবনের প্রয়োজন হবে না। 

RelatedPosts

মুখের ছোট ছোট ব্রণ দূর করার উপায়

মুখের ছোট ছোট ব্রণ দূর করার উপায়

মুখে ব্রণ বের হওয়াটা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। ত্বকের ঔজ্জ্বল্যতা এবং সৌন্দর্য সবকিছুকে নিমিষে নষ্ট করে দিতে ব্রণের বিকল্প নেই। আর তাই এই সমস্যাটা যখন দেখা দেয় তখন... Continue

পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়ার কারণ কী

পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়ার কারণ কী

ইমারজেন্সি পিল খাওয়ার পর মাসিক না হওয়ার কারণ কি হতে পারে সেটা ভেবে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। জেনে রাখা ভালো যে পিল মাসিক হওয়ার কোন ঔষধ নয় বরং... Continue

ফেমিকন-এর-ছবি

ফেমিকন খাওয়ার নিয়ম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, দাম ও উপকারিতা

ফেমিকন খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে প্রত্যেক বিবাহিত মহিলা এবং পুরুষদের অবগত হওয়া উচিত। আমাদের দেশের প্রায় ৪০% বিবাহিত মহিলারা জীবনের কোন না কোন সময়ে ফেমিকন পিল সেবন করে থাকেন।... Continue

বিয়ের পর জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

বিয়ের পর জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমূহ। প্রাকৃতিক ও চিকিৎসার মাধ্যমে।

বিয়ের পর জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমূহ দাম্পত্য জীবনের অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়ায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে বিশেষ করে নবদম্পতিরা দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে ভুগে থাকেন। কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে... Continue

বাচ্চা হওয়ার পর পিল খাওয়ার নিয়ম

বাচ্চা হওয়ার পর পিল খাওয়ার নিয়ম কী

বাচ্চা হওয়ার পর পিল সেবনের নিয়ম গুলো সাধারণত অন্যান্য মহিলাদের মতই। তবে এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত মহিলাদের সন্তান প্রসব করার ২১ দিন পর থেকেই... Continue

গর্ভাবস্থায় সহবাস করা কতটা নিরাপদ

গর্ভাবস্থায় সহবাস করা কতটা নিরাপদ?

গর্ভাবস্থায় সহবাস করা কতটা নিরাপদ সে ব্যাপারে প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলার জানা অত্যন্ত জরুরী। কারণ অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং গর্ভের সন্তানের জন্য ছোটখাটো কিছু ভুল বড় ধরনের বিপদ বয়ে আনতে... Continue