স্বপ্নদোষ কি ও কেন হয়? স্বপ্নদোষ বন্ধ করার উপায়।
স্বপ্নদোষ হলো পুরুষদের ঘুমের মধ্যে ধাতু নির্গমন। অনেক সময় দেখা যায় যে ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সী পুরুষদের ঘুমন্ত অবস্থায় গভীর রাতে কিংবা ভোরের দিকে মনের অজান্তেই লিঙ্গ উত্তেজিত হয়ে বীর্যপাত হয়ে যায়। এই বীর্যপাত হয় অনেক সময় স্বপ্নে অনেক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবার মাধ্যমে কিংবা কোন ধরনের স্বপ্ন দেখা ছাড়াই। তবে লিঙ্গ উত্থান ছাড়াও অনেক সময় স্বপ্নদোষ হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে স্বপ্নদোষ শরীরের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর না হলেও এর পরিমাণ যখন বেড়ে যায় তখন এটি শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই অতিরিক্ত স্বপ্নদোষ জনিত সমস্যার শুরুর দিকেই ঘরোয়া কিছু জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করলে এর থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়।
স্বপ্নদোষ কিছু ক্ষেত্রে যৌন সমস্যা জনিত কারণে হয় আবার অনেক সময় কোন কারন ছাড়াই হয়ে থাকে। তবে এটা বেশি দেখা যায় টিনেজার পুরুষদের ক্ষেত্রে। একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ৮৫% পুরুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বপ্নদোষের সম্মুখীন হয়েছে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর বাহিরে ৯৮% পুরুষরা স্বপ্নদোষের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী অবিবাহিত 15 বছর বয়সী ছেলেদের ক্ষেত্রে সপ্তাহে ০.৩৬ বার থেকে শুরু করে ৪০ বছর বয়সী পুরুষদের ক্ষেত্রে সপ্তাহে ০.১৮ বার স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে। কিন্তু বিবাহিত পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সীদের সপ্তাহে ০.২৩ বার থেকে শুরু করে ৫০ বছর বয়সী পুরুষদের ক্ষেত্রে সপ্তাহে ০.১৫ বার স্বপ্নদোষ হয়।
স্বপ্নদোষ কেন হয়?
স্বপ্নদোষের প্রধান কারন গুলোর মধ্যে লিঙ্গের দুর্বলতা, স্নায়ু দুর্বলতা, বীর্যের ঘনত্ব কমে যাওয়া, অতিরিক্ত হস্তমৈথুন করা, উত্তেজক সিনেমা দেখা কিংবা পর্নো সিনেমা দেখা, রাতে ঘুমাতে যাবার আগে যৌন উত্তেজনাকর কোন কাজ করা কিংবা কোন কিছু দেখা উল্লেখযোগ্য। তবে অনেক সময় দেখা যায় যে কিছু পুরুষদের ঘুমানোর পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেও স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে। যেমন একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে স্বপ্নদোষে আক্রান্ত ৪০ শতাংশ পুরুষের স্বপ্নদোষ হয় চিৎ হয়ে ঘুমানোর কারণে। তাছাড়া বীর্যের পরিমাণ বেড়ে গেলে তখন সেটি ভেতরে থাকতে না পেরে অনেক সময় স্বপ্নদোষের মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে আসে। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে মূত্রথলিতে অত্যাধিক মুত্র জমে যাওয়ার কারণে স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে।
বিশ্ব বিখ্যাত যৌন গবেষক আলফ্রেড কিনসে তার গবেষণায় দেখেছেন যে ঘনঘন হস্তমৈথুন এবং ঘন ঘন স্বপ্নদোষ একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যারা অতিরিক্ত হস্তমৈথুন করে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষ খুব কম হয় অন্যদিকে যাদের ঘন ঘন স্বপ্নদোষ হয়ে থাকে তারা কম হস্তমৈথুন করেন।
গবেষণা অনুযায়ী পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেড়ে গেলে স্বপ্নদোষের মাত্রা ১৭% থেকে ৯০ শতাংশ গিয়ে দাঁড়াতে পারে। বেশিরভাগ বালকদের ক্ষেত্রে বীর্যপাতের প্রথম অভিজ্ঞতা হিসেবে পরিগণিত হয় এটি।
মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে ৫ হাজার ৬২৮ জন মহিলার মধ্যে প্রায় ৪০% মহিলারা ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের জীবনে কমপক্ষে একবার স্বপ্নদোষের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। এদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ মহিলারা ২১ বছর বয়সে এবং কিছু মহিলারা ১৩ বছর বয়সে প্রথম এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন।
পুরুষদের ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষ এর ফলে বীর্য স্খলন এর কারণে যৌনাঙ্গ একেবারে ভিজে যায়। কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনিপথে নিঃসরণ ছাড়াই স্বপ্নদোষ হতে পারে।
১৮ এবং ১৯ শতকের দিকে যদি কারো ঘন ঘন স্বপ্নদোষ হতো তাহলে সেটা ধাতু দুর্বলতা বা স্পারম্যাটোরিয়া হিসেবে বিবেচিত হতো। এ ক্ষেত্রে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ঔষধ সেবনের মাধ্যমে এটি বন্ধ করার চেষ্টা করে থাকেন যদিও বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী এর কোনো ভিত্তি নেই।
স্বপ্নদোষের ক্ষতিকর প্রভাব
মাসে ২ থেকে ৩ বার স্বপ্নদোষ হওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এই পরিমাণ যখন অত্যধিক বেড়ে যাবে তখন এটি শারীরিক এবং মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। স্বপ্নদোষের কারনে যে সকল ক্ষতিকর প্রভাব মানবদেহে পড়ে থাকে সেগুলো হলোঃ
- মাথাব্যথা
- ঝিমুনি
- চোখে কম দেখা
- শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করা
- স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া
- শারীরিক অবসাদ
- ক্ষুধা কমে যাওয়া
- কাজে মনোযোগ দিতে না পারা
- লিঙ্গের বক্রতা
- বীর্য পাতলা হয়ে যাওয়া
- লিঙ্গের শিথিলতা
- হাটুতে কিংবা শরীরের গিরায় গিরায় ব্যথা করা
- বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি।
স্বপ্নদোষ এর ফলে এই সমস্যাগুলো দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
স্বপ্নদোষ হলে কি গোসল ফরজ ?
হ্যাঁ, স্বপ্নদোষ দিনে হোক কিংবা রাতে হোক, হবার পর ওই ব্যক্তির ওপর গোসল ফরজ হয়ে যায়। গোসল না করলে কিংবা লিঙ্গ পানি দিয়ে পরিষ্কার না করলে সেখানে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
মেয়েদের কি স্বপ্নদোষ হয় ?
হ্যাঁ, ছেলেদের মত মেয়েদেরও স্বপ্নদোষ হয়। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে বীর্যের পরিমান কম থাকায় ছেলেদের মতো কাপড় একেবারে ভিজে যায় না। মেয়েদের ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষ হলে মেয়েদের যৌনাঙ্গ কিছুটা ভিজে যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে।
মেয়েদের স্বপ্নদোষ হলে করণীয় ?
মেয়েদের স্বপ্নদোষ হলে বিশেষ কোনো করণীয় নেই। বরং পারতপক্ষে স্বপ্নদোষ হওয়ার পর মূত্র ত্যাগ করতে হবে এবং পরিষ্কার পানি দিয়ে যৌনাঙ্গ ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
- দ্রুত বীর্য পাতের স্থায়ী সমাধান ও ঘরোয়া চিকিৎসা
- হস্তমৈথুন কী? হস্ত মৈথুনের ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর থেকে মুক্তির উপায়।
- ফোরপ্লে কি এবং কিভাবে করতে হয় ?
স্বপ্নদোষ হলে কি কি করা যাবে না ?
প্রথমত স্বপ্নদোষ হলে গোসল করা জরুরি। গোসল না করে কিংবা শরীর পরিষ্কার না করে পারতপক্ষে কোথাও যাওয়া না কোন কাজ করা উচিত নয়। তবে কোন কিছু করতে চাইলে বা কোথাও যেতে চাইলে গোসল না করলে সে ক্ষেত্রে মুসলিমদের জন্য অযু করে নেয়া উত্তম। কিন্তু যদি আপনি প্রার্থনা বা ইবাদত করতে চান সেক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে ফরজ গোসল করতে হবে।
স্বপ্নদোষ হলে কি রোজা হবে ?
হ্যাঁ, স্বপ্নদোষ হলে রোজা হবে। কিন্তু রোজা থাকা অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে যত দ্রুত সম্ভব গোসল করার মাধ্যমে শরীর পরিষ্কার করতে হবে। অন্যথায় রোজা হালকা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্বপ্নদোষ বন্ধ করার উপায়
অতিরিক্ত স্বপ্নদোষ হওয়ার শুরুর দিকেই যদি বুঝতে পারা যায় তবে কিছু নিয়ম-কনুন এবং জীবন যাপনের পদ্ধতি অনুসরণ করলে এর থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব।
- ঘুমানোর আগে মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপে যৌন উত্তেজনামূলক কোনো ছবি অথবা ভিডিও দেখা যাবে না।
- বিশ্বাস করতে হবে যে জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বপ্নদোষ থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব।
- অতিরিক্ত হস্তমৈথুনের অভ্যাস থাকলে তা যত দ্রুত সম্ভব পরিহার করতে হবে।
- বাহিরে চলাফেরার সময় নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
- ঘুমানোর আগে প্রস্রাব করে ঘুমাতে হবে।
- ঘুম যদি পাতলা হয়ে থাকে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শমতো ঔষধ সেবন করতে হবে। তবে ঘুমানোর আগে মাথায় তেল ব্যবহার করে ঘুমালে অনেক সময় শান্তিতে ঘুমানো যায়।
- নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম এবং যোগ সাধন করতে হবে। যোগ সাধন বা মেডিটেশন মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে যার মাধ্যমে খুব সহজেই স্বপ্নদোষের পরিমান কমিয়ে আনা সম্ভব।
- যাদের স্বপ্নদোষের সমস্যা রয়েছে তাদের খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। পারতপক্ষে রাতে ঘুমানোর পূর্বে অম্লজাতীয় কিংবা ভারী খাবার খাওয়া যাবেনা।
- শরীরে রক্তচাপ বাড়ায় এমন খাবার রাতে খাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে।
- এ সকল পদ্ধতি অনুসরণ করলে আশা করা যায় খুব সহজেই অতিরিক্ত স্বপ্নদোষ হওয়া থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব। এরপরেও যদি স্বপ্নদোষ এর সমস্যা না কমে তবে যত দ্রুত সম্ভব যৌন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় মেনে চললে স্বপ্নদোষ কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন
- শরীর ঠান্ডা রাখে এমন খাবার রাতে ঘুমানোর পূর্বে খাওয়া যেতে পারে। যেমন লাউয়ের জুস।
- আমলকির রস শরীরের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। নিয়মিত আমলকির রস সেবন করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে যার মাধ্যমে সহজেই স্বপ্নদোষ নির্মূল করা সম্ভব।
- পরিমিত পরিমাণে পেঁয়াজ এবং রসুন খেতে হবে। রসুন শরীরে এন্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি বীর্যের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। যাদের পাতলা বীর্যের কারনে সপ্নদোষ হয় তাদের জন্য রসুন স্বপ্নদোষের সবচেয়ে উপযোগী ওষুধ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।
- সম্ভব হলে নিয়মিত দুধ এবং কলা খেতে হবে। এতে করে শরীরে শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং বীর্যের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে।
- প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে মধু কালোজিরা এবং খেজুর খাওয়া যেতে পারে। কালোজিরা কে বলা হয় মৃত্যু ব্যতিত সকল রোগের মহা ঔষধ। অন্যদিকে মধু এবং খেজুর যৌন শক্তি বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
- অকাল বীর্যপাত রোধে ছেলেরী এবং মেথির রস অত্যন্ত কার্যকরী। ২ঃ১ অনুপাতে সেলেরি ও মেথির রস মধুর সাথে মিশিয়ে নিয়মিত খেলে স্বপ্নদোষ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
- সেই সাথে নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে যাতে করে স্বপ্নদোষের ক্ষেত্রে যে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো কাজ করে সেগুলো থেকে দূরে থাকা যায়।
আশাকরি যাদের অতিরিক্ত স্বপ্নদোষের সমস্যা রয়েছে তারা উপরের নিয়ম কানুন গুলো মেনে চললে খুব সহজেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। স্বপ্নদোষ এক ধরনের রোগ যা লুকিয়ে রাখার মাধ্যমে কখনো নিজের ক্ষতি করবেন না। সময়মতো চিকিৎসা না করলে স্বপ্নদোষের কারনে যৌনাঙ্গ পঙ্গু হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।