কিডনি রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার
বর্তমানে পৃথিবীতে মানব জাতি যেসব প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো কিডনি রোগ। কিডনি আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এটা আমাদের কারোরই অজানা নয়। মানবদেহের কোমরের কিছুটা ওপরে দুই পাশে দুটি কিডনি থাকে। যা আমাদের দেহের বিপাক ক্রিয়ার তৈরি সব বজ্র পদার্থ শরীর থেকে বের হতে সাহায্য করে। কিন্তু এটি যদি অকার্যকর হয়ে পড়ে তাহলে শরীরে ক্ষতিকর বজ্র রক্ত জমা হয় আর তখন বেঁচে থাকা দুষ্কর হয়ে পরে।
বর্তমানে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া এই রোগ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মূলত সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে কিডনি রোগের শেষ পরিণতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। তবে কিডনি রোগ নীরবে শরীরের ক্ষতি করে তাই খুব জটিল অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এর লক্ষণ গুলো পুরোপুরি প্রকাশ পায় না। কিন্তু আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছে যারা কোমর ব্যথা হলে বা প্রসাব হলুদ হলেই ভয় পেয়ে যান। আর ধরে নেন, বুঝি কিডনি রোগ হয়েছে!
কিডনি রোগের লক্ষণ
তবে এই ধারণাটি পুরোপুরি সত্য না হলেও আংশিক সত্য। কারণ, কিডনি রোগের একটা লক্ষণ প্রসাবের পরিবর্তন। এর প্রধান লক্ষণ হলো প্রসাবে পরিবর্তন হওয়া। অর্থাৎ কিডনির সমস্যা হলে প্রসাব কম বা বেশি হয়। বিশেষত রাতে এই সমস্যাটা বেড়ে যায়। সেই সাথে প্রসাবের রং হয় গাঢ়। আবার কখনো কখনো এমনও হয় যে, প্রসাবের বেগ অনুভব হচ্ছে কিন্তু প্রসাব হচ্ছে না।
দ্বিতীয়তঃ প্রসাবের সময় ব্যথা। কিডনি রোগের আরেকটি লক্ষণ এটি। প্রসাবের সময় ব্যথা, জ্বালাপোড়া ইউরিনারি ট্রাক ইনফেকশন এর লক্ষন। আর এটি যখন মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যায় আর কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ে তখন জ্বর হয়, পাশাপাশি পিঠের পেছনে ব্যথা হয়। তাই পেট ব্যথা, জ্বর আর প্রসাবে জ্বালাপোড়া হলে বুঝতে হবে আপনার কিডনি রোগ হয়েছে।
তবে হ্যাঁ শুধু এই দুটি লক্ষণই কিন্তু যথেষ্ট নয়। এর আরো কিছু লক্ষণ রয়েছে যেমন,
- প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া,
- ত্বকে দাগ হওয়া,
- বমি বা বমি বমি ভাব, পেছনে ব্যাথা অর্থাৎ পিঠের পাশে নিচের দিকে ব্যথা,
- সব সময় শীত বোধ হওয়া,
- দেহে ফোলা ফোলা ভাব,
- ছোট ছোট শ্বাস নেওয়া এবং
- মনোযোগ দিতে অসুবিধা হওয়া।
আমাদের শরীরে যখন কিডনি রোগ বাসা বাঁধে তখন ফুসফুসে তরল পদার্থ জমা হয় সেই সাথে দেখা দেয় রক্তশূন্যতা। আর এর থেকেই সৃষ্টি হয় শ্বাসকষ্টের। তাই শ্বাসের সমস্যা হওয়ার কারণে অনেকের ছোট ছোট শ্বাস নিতে হয়।
আর বমি বমি হবার কারণ, রক্তে বর্জনীয় পদার্থ বেড়ে যাওয়া। পাশাপাশি ত্বকের যে সমস্যাটি দেখা দেয়, এর কারণও রক্তে বর্জ্যপদার্থ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া।
কিডনি রোগের কারণে যখন কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়ে তখন রক্তে অতিরিক্ত বজ্র পদার্থ বেড়ে যায়, যা ত্বকের চুলকানি বা rass তৈরি হতে সাহায্য করে। তাই এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে খুব দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে এবং যথোপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
এতক্ষণ তো জানলাম কিডনি রোগের লক্ষণ। কিন্তু এই রোগের আসল কারণ কি?. এটা আমরা অনেকেই জানিনা। এক গবেষণায় জানা গেছে, কিডনি মূলত দুটি কারণে তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
একটা হলো, স্বল্প সময়ে কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়া। অর্থাৎ কোনো কারণে যদি কিডনিতে রক্তপ্রবাহ হঠাৎ কমে যায় তাহলেই দেখা দিতে পারে এই সমস্যা। এই ধরুন আপনার ডায়রিয়া হয়েছে। ঠিক সেই সময় যদি আপনার শরীরে সুপেয় ও নিরাপদ পানির অভাব ঘটে তাহলেই অকার্যকর হয়ে পড়বে আপনার কিডনি। অর্থাৎ ডায়রিয়া বা পানিবাহিত যেকোনো রোগ বালাই কিডনি অকার্যকারিতার প্রধান কারণ।
এছাড়াও ডেঙ্গু জ্বর, ব্যথানাশক জাতীয় ওষুধ সেবন এবং অকারনে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলেও সমস্যা দেখা দিতে পারে কিডনির।
আর আরেক ধরনের কিডনির অকার্যকারিতা হয় ধীরে ধীরে। যাকে বলা হয় ক্রনিক কিডনি ডিজিজ। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনির নিজস্ব কিছু রোগ, এমন সমস্যার জন্য দায়ী।
আমাদের দেশে এই রোগের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সুপেয় ও নিরাপদ পানির অভাব। কিন্তু খুব সম্প্রতি ক্রনিক কিডনি ডিজিস সমস্যাটি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে দিন দিন বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে রোগীরা।
কারণ এই রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। তাই সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা দুষ্প্রাপ্য। তাই নিজেকে সুস্থ রাখতে এবং অর্থ বাঁচাতে আমাদের সর্বপ্রথম এই রোগের প্রতিকার গুলো জেনে মেনে চলা উচিত।
যেহেতু কিডনি রোগ পানিশূন্যতার কারণে হয়ে থাকে। তাই আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ পর্যাপ্ত পরিমাণ স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা। সেইসাথে,
- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত রক্তের শর্করা এবং প্রস্রাবে এলবুমিন পরীক্ষা করা সেই সাথে রক্তের হিমোগ্লোবিন এওয়ানসি নিয়ন্ত্রণে রাখা।।
- উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
- ডায়রিয়া বমি ও রক্ত আমাশয় হলে দ্রুত খাবার স্যালাইন খাওয়া।
- প্রসাবের ঘনঘন ইনফেকশনের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত অ্যান্টিবায়োটিক ও তীব্র ব্যথা নাশক ঔষধ সেবন না করা।
- শিশুদের গলাব্যথা জ্বর ও ত্বকে খোস-পাচড়ার দ্রুত সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা।
- ধূমপান বর্জন করা।
- বয়স ৪০ পেরোনোর পর প্রত্যেকেরই রক্তে শর্করার রক্তচাপ ও প্রসাবে আমিষের পরিমাণ পরীক্ষা করা ও ডাক্তারি পরামর্শ গ্রহণ করা।
- প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটা।
- খাবারে লবণের পরিমাণ কমানো।
- নিরাপদ পানি পান করা।
- সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে কাজে লাগানো
- খোলা খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা।
- জনসাস্থ শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মশা-মাছি ধ্বংস করা ও ভেজাল খাদ্য বিরোধী অভিযান চালানো।
- নিয়মিত কায়িক শ্রমের অভ্যাস করা বা ব্যায়াম করা।
- সেইসাথে বছরে একবার হলেও কিডনি পরীক্ষা করা।
এছাড়াও কিডনি রোগ থেকে মুক্তি পেতে এবং এটি পরিষ্কার রাখতে বেশ কিছু ভেষজ উপাদান গ্রহণ করতে পারবেন। যেমন
রসুন, আদা
রসুন কিডনিসহ দেহের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কে ভালো রাখতে সাহায্য করে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ এন্ড হিউম্যান।
রসুন দেহ থেকে বাড়তি সোডিয়াম দূর করতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে এলআইসিন, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি ফাঙ্গাস উপাদান। যা কিডনি থেকে বিষাক্ত বজ্র পদার্থ দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ঠিক একইভাবে আদাও কিডনি বিকলাঙ্গ হাওয়া থেকে সাহায্য করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জিনজেরোল নামের একটি কার্যকরী উপাদান যা হজমে সাহায্য করে এবং শরীরের প্রদাহ কমায়। এছাড়াও রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে আদা সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকটা কার্যকরী।
এছাড়াও ভেষজ হিসেবে গোক্ষুর, রক্তচন্দন, ও জুনিপার ব্যারেজ উল্লেখযোগ্য।
তবে হ্যাঁ, আপনি যদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে এই সময়ে আপনার করণীয়, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করা এবং খাবারের তালিকা থেকে
- চকলেট,
- চকলেট দুধ,
- খেজুর,
- আচার,
- টমেটো,
- পালংশাক,
- মিষ্টি কুমড়া,
- মাশরুম,
- বাদাম,
- ব্রকলি,
- পিচস,
- মুরগির মাংস,
- খাসির মাংস,
- গরুর মাংস ইত্যাদি খাবার গুলো বাদ দেওয়া।
কারণ রুল এইডস বা আর্ট নিয়ম বলে একটা কথা আছে। তাই শুধুমাত্র নিয়ম গুলো ঠিকঠাক পালন করলেই কিডনি সুস্থ রাখার সম্ভব। এই ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের ডক্টর এ এস এম. তামিল আনোয়ার বলেছেন,
- যাদের প্রেসার আছে তাদের প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে।
- নিয়মিত ব্যায়াম সেটা হতে পারে সাইক্লিং সুইমিং বা হাটাহাটি। যাদের ব্যথার ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস আছে তাদেরকে তা পরিহার করতে হবে আর যারা ভাতের সঙ্গে অতিরিক্ত কাঁচা লবণ খান সেটাও পরিহার করতে হবে।
- এছাড়া নিয়মিত স্ক্রীনিং করতে হবে যদিও আমাদের এই দেশে তার ব্যবস্থা নেই তবুও অন্তত একবার হলেও কিডনিটা ভালো আছে কিনা চেকআপ করানো প্রয়োজন।
- ইতোমধ্যে তো আমরা আপনাদেরকে খাদ্যাভাসের কথা বলেছি। ডক্টর তামিল আনোয়ারও তার বক্তব্যে বলেছেন আপনারা ফ্রুটস জাতীয় খাবার কম খাবেন দেড় লিটারের বেশি পানি খাবেন না। যদি ঘাম বেশি হয় তখন দুই লিটার পর্যন্ত খেতে পারবেন।
- অবশ্যই তেল চর্বি জাতীয় খাবার কম খাবেন। ইলিশ মাছ চিংড়ি মাছ শুটকি মাছ পাঙ্গাস মাছ খাদ্যতালিকায় অল্প পরিমাণ রাখবেন।
- শাক সবজির মধ্যে পুঁইশাক ও লাল শাক খাওয়া বারণ দেশে জাতীয় সবজির মধ্যে বাদ দেবেন সিম্পল এবং ফুলকপি বাঁধাকপি।
- সেই সাথে যেকোনো ধরনের ফল আর ফলের রস কম খাবেন বেশি পরিমাণ খেতে চাইলে আপেল পেয়ারা বিচি ফেলে দিয়ে খেতে পারেন। তবে তিনটা ফল খেতে আমরা সম্পূর্ণভাবে নিষেধ করি
১. কামরাঙ্গা
২. বিলম্ব
৩. অ্যালোভেরা।
তবে অতিরিক্ত পরিমাণে ডিম দুধ খেতে পারবেন সেইসাথে চা-কফিতে নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা চিনি ছাড়া চা খাবেন।