জেনে নিন আমের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
ফলের রাজা আম। আমের উপকারিতা অতুলনীয়। খেতে যেমন রসালো তেমন দেখতেও লোভনীয়। এর স্বাদ আর গন্ধের সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার মত কিছুই নেই। অত্যন্ত সুন্দর সুস্বাদু এই ফল কাঁচাপাকা সব ভাবেই খাওয়া যায়, সেইসাথে পাওয়া যায় অবাক করা পুষ্টিগুণ ও বেশ কিছু উপকারিতা।
শখের বসে অথবা স্বাদের কারণে হরহামেশাই আমরা আম খেয়ে থাকি। বলা যায়, সব বয়সীর কাছেই এটি পছন্দের ফল। কিন্তু কেউই পুরোপুরি অবগত নই যে এই ফল আমাদের শরীরের জন্য কতটুকু উপকারী। তাই খুব সম্প্রতি মৌসুমী ফল আমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের “খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান” বিভাগের প্রধান ফারাহ মাসুদা বলেন –
আরও পড়ুনঃ সেক্সে রসুনের উপকারিতা
“আম এমন একটি ফল যেটি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, সেই সাথে শরীরের বিভিন্ন পুষ্টির চাহিদা পূরণে সহযোগিতা করে।” তাই কথা না বাড়িয়ে চলুন খুব তাড়াতাড়ি জেনে নেই আম খাওয়ার এমন কিছু উপকারিতা যেগুলো আমাদের কাছে একদম অজানা।
আমের উপকারিতা
আম এমন একটি ফল যেটা আমাদের শরীরে ভিটামিনের যোগান দিয়ে থাকে। পুষ্টি উপাদানে ভরপুর উপকারী এই ফলটিতে প্রচুর খনিজ লবণ এবং বিভিন্ন ভিটামিনের উপাদান রয়েছে।
মূলত ভিটামিন এ, ভিটামিন সি , ভিটামিন বি৬ অধিক পরিমাণে রয়েছে এতে। পাশাপাশি আছে অ্যামাইনো অ্যাসিড, পটাশিয়াম ও কপার। কাঁচা আমে ভিটামিন সি এর পরিমাণ বেশি। তবে পাকা আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ লবণ। যা আমাদের দেহের জন্য অনেক বেশি উপকারী।
বলতে পারেন, নানা পুষ্টি উপাদানে ভরপুর পাকা আম শরীর সুস্থ রাখার পাশাপাশি কর্মশক্তি যোগানে সহায়তা প্রদান করে। শরীরে নানাভাবে শক্তি জুগিয়ে ও ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করে মানব দেহকে সুস্থ রাখতে আমের পুষ্টি উপাদান আমাদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
আরও পড়ুনঃ পেয়ারার উপকারিতা
কারণ পরীক্ষা করে প্রমাণিত পাকা আমে ক্যারোটিন এর মাত্রা সবচেয়ে বেশি। জানা যায়, প্রতি ১০০ গ্রামে ২৭৪০ মাইক্রো গ্রাম প্রোটিন থাকে। এতে ১.৩ গ্রাম আয়রন, ১৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৬ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ১৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ০.৯ মিলিগ্রাম রিবোফ্লাভিন, সেইসাথে ০.০৮ গ্রাম থায়ামিন থাকে।
এছাড়াও রয়েছে ভিটামিন বি-১ ও ভিটামিন বি-২। মূলত প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ০.১ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১ ও ০.০৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ থাকে। সেই সাথে প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ০.৫ গ্রাম খনিজ লবণ থাকে। পাশাপাশি আমে প্রোটিন ও ফ্যাট রয়েছে। জানা যায় প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ১ গ্রাম প্রোটিন ও ০.৭ গ্রাম ফ্যাট থাকে। সেইসাথে শ্বেতসারের ভালো উৎস আম।
এবার চলুন জেনে নেই আমের এমন কিছু উপকারিতা যেগুলো বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত।
১. চোখ ভালো রাখতে সাহায্য করেঃ ভিটামিন এ আমাদের রাতকানা রোগ থেকে বাঁচায়। যদিও বর্তমানে এই রোগের খুব একটা দেখা মেলে না। তবুও বলা যায় চোখের সুস্থতার জন্য বেশি বেশি আম খাওয়া খুবই জরুরী। কেননা আমে ‘ভিটামিন এ’ রয়েছে যেটা আমাদের রাতকানা রোগ থেকে বাঁচায়। সেইসাথে চোখের দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
পরীক্ষা করে জানা যায়, আপনি যদি প্রতিদিন ১ কাপ আম খেতে পারেন তাহলে এটি আপনার শরীরে প্রায় ২৫ শতাংশের মতো ভিটামিন-এ এর যোগান দিতে সক্ষম, যা চোখের অন্ধত্ব দূর করবে, দৃষ্টিশক্তি শক্তিশালী করবে এবং শুষ্ক চোখের সমস্যা প্রতিরোধ করবে। এক কথায় সকল প্রকারের সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে চোখের সুস্থতা দান করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম আম।
আরও পড়ুনঃ তেতুলের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
২. ত্বকের যত্নের জন্য অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেঃ আম ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। ত্বককে সুন্দর উজ্জ্বল ও মসৃণ করতে সহায়তা প্রদান করে এটি। এই ফল এতটাই পুষ্টিগুণসম্পন্ন যে, ত্বককে ভেতর থেকে রাখে পরিষ্কার।
মূলত আমাদের ত্বকের লোম কুপের গোড়া পরিষ্কার রাখতে ও ব্রণের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে আম। বিশেষ করে ফুসকুড়ি দূর করে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৩. ক্যান্সার প্রতিরোধে অর্থাৎ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষমঃ কোয়েরসেটিন, ফাইসেটিন, আইসোকোয়েরসেটিন, অ্যাস্ট্রাগ্যালিন, গ্যালিক অ্যাসিড ও মিথাইল গ্যালেট নামের কঠিন নামওয়ালা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো আছে আমে। যা স্তন ক্যান্সার থেকে শুরু করে কোলন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার ও লিউকেমিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে বেশ কাজের। তাই বলা হয়ে থাকে আমের পুষ্টিগুণ আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী উপাদান, যা ক্যান্সার যোদ্ধা হয়ে আমাদের শরীরকে রক্ষা করে।
৪. হজমশক্তি বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করেঃ খাবার থেকে প্রাপ্ত প্রয়োজনীয় উপাদান যাতে শরীরের সব অংশে ভালোভাবে যায় সেই দিকে খেয়াল রাখে আম। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটেরি ফাইবার, যা অন্ত্র ও পরিপাক নালীর কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। আর আমাদের শরীরকে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেয়।
৫. ঠান্ডা জনিত সমস্যা দূর করেঃ প্রচুর ভিটামিন এ এবং ডি রয়েছে এতে। যে কারণে এই দুই ভিটামিন ঠান্ডাজনিত সমস্যা দ্রুত উপশম করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই ঠাণ্ডা কিংবা ফ্লু দেখা দিলে বেশি বেশি আম খেতে পারেন, যা আপনার শরীরকে দ্রুত সুস্থ ও স্বাভাবিক করতে সাহায্য করবে।
৬. স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেঃ আমে রয়েছে গ্লুটামিক অ্যাসিড, যা মস্তিষ্কের কোষ উজ্জীবিত করে থাকে। তাই প্রচুর পরিমাণে মস্তিষ্কে চাপ কমাতে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে বেশী বেশি আম খাওয়া খুবই জরুরী।
৭. স্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করেঃ হিট স্ট্রোক গরমের সময়ে সাধারন একটা ঘটনা। কিন্তু আম খাবার ফলে আমাদের শরীরের ভেতরটা শীতল থাকে এবং অতিরিক্ত গরম হাওয়া বের হয়ে যায়, যারফলে শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলো ঠান্ডা থাকে আর হিট স্ট্রোক ঠেকাতে সক্ষম হয়। তাই একজন মানুষের গরমের সময় প্রতিদিন আম খাওয়া অত্যন্ত জরুরী।
৮. কোলেস্টেরলের মাত্রা বজায় রাখেঃ এই ফলটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, পেকটিন, ভিটামিন সি, যা কোলেস্টেরল লেভেল এর ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই কোলেস্টেরলের পরিমাণ সঠিক মাত্রায় রাখতে একজন ব্যক্তির প্রতিদিন আম খাওয়া প্রয়োজন।
আরও পড়ুনঃ তরমুজের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
৯. ওজনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করেঃ এতে এতো পরিমাণে ভিটামিন আছে যা রোজকার ভিটামিনের চাহিদা মিটিয়ে দিতে সক্ষম। জানলে অবাক হবেন, একটি আম আপনার শরীরে প্রতিদিনের ভিটামিনের চাহিদা মিটিয়ে দেবে। আবার এর ফাইবারও যোগাবে পুষ্টি ও শক্তি। তাই যারা ওজন কমানোর কথা ভাবছেন বা অতিরিক্ত ওজন নিয়ে বেশ চিন্তিত তাদেরকে বলব, বেশি বেশি আম খান। বার্গার, কোলড্রিংস বা সাব স্যান্ডউইচ এর বিকল্প খাবার হিসেবে বেছে নিন অত্যন্ত সুস্বাদু রসালো ফল আমকে, যা আপনার শরীরকে দ্রুত চিকন করবে, ওজন কমাবে, সেই সাথে শরীরের ফিটনেস ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
১০. মিনারেল ঘাটতি দূর করেঃ শরীরে মিনারেল এর ঘাটতি দেখা দিলে নানা রকমের অসুখ বাসা বাঁধতে সক্ষম হয়। কিন্তু আম মিনারেলের ঘাটতি অনেকটাই পূরণ করতে সক্ষম। কারণ, এতে রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম। তাই আপনি যদি যেকোনো পরিশ্রমের পর আম খান তাহলে পটাশিয়াম এর ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হয়ে যাবে। সেই সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া প্রয়োজনীয় লবণের ঘাটতি পূরণ হবে, আর আপনার শরীর হয়ে উঠবে ভেতর থেকে চাঙ্গা।
১১. রক্তের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে সাহায্য করেঃ আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, যা রক্তনালী সমূহের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে এবং রক্তকণিকা গঠনে সাহায্য করে। এতে করে যক্ষ্মা, রক্তস্বল্পতা ও কলেরা রোগের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাহলে বুঝতেই পারছেন আমের উপকারিতা আসলে কতটুকু।
১২. শরীরের সকল প্রকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ আমে রয়েছে সকল প্রকার রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার পুষ্টি উপাদান। যে কারণে এই করোনাকালে আমে থাকা ক্যারোটিনয়েড বাড়িয়ে দেবে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সেই সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে ভিটামিন-সি তো আছেই।
১৩. লাভ ফ্রুটঃ ইংরেজিতে কঠিন একটা শব্দ আছে সেটি হলো আফ্রোডিজিয়াক, যার বাংলা অর্থ এমন, যাহা খাইলে মনে ভালোবাসার উদ্রেক হয়। সত্যি বলতে বিশ্বাস না হলেও এটাই সত্যি যে, আম এমন একটি ফল যেটা খেলে আপনার ভেতরে ভালোবাসা জেগে উঠবে আর এটা বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত। তাই মৌসুম থাকতেই প্রিয়জনকে বেশি বেশি আম উপহার দিন এবং নিজেও আম খান। এতে করে আপনি যেমন শারীরিক দিক দিয়ে সুস্থ থাকবেন, ঠিক তেমনি মানসিকভাবেও সুস্থতা লাভ করবেন।
১৪. শরীরের ক্ষয় রোধ করেঃ আমাদের শরীরের ক্ষয়রোধ করে থাকে আম। প্রতিদিন এই ফল খেলে দেহের ক্ষয় রোধ হয় এবং স্থূলতা কমিয়ে শারীরিক গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
আরও পড়ুনঃ বেলের উপকারিতা
১৫. চেহারায় বয়সের ছাপ মুছতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেঃ নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন তাইনা? আসলে এটি এমন একটি ফল যাতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের একাধিক সমস্যাকে দূর করতে সাহায্য করে। সেই সাথে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। ত্বকে ফুটিয়ে তোলে এক তরুণ লাবণ্য।
তাহলে বুঝতেই পারছেন আম আমাদের শরীরের জন্য কতখানি উপকারী। আসছে আমের সিজন। তাই অবশ্যই এখন থেকে আপনি এবং আপনার পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত আম খাবেন। সেই সাথে যারা আমের উপকারিতা সম্পর্কে অবগত নয় তাদের সাথে তথ্য গুলো শেয়ার করবেন।