জেনে নিন বেলের উপকারিতা
শীতের শেষ গরমের শুরু, এই সময় আবহাওয়ার পরিবর্তন যেন নাড়িয়ে দেয় শরীরকে। ছোট থেকে বড় সব বয়সী মানুষেরই একেবারে নাজেহাল দশা। কিন্তু জানেন কি এর থেকে পরিত্রাণের জন্য শুধুমাত্র এক গ্লাস বেলের শরবতই যথেষ্ট। কারণ, এটি এমন একটি ফল, যা সকল প্রকার পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে রয়েছে নানান ঔষধিগুণ, যা আমাদের দেহের অনেক উপকার করে থাকে। তাও আবার কাঁচাপাকা দুই অবস্থাতেই বেল সমান উপকারী। এটি এমন একটি ফল, যেটি কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে শুরু করে সংক্রমণজনিত যেকোনো সমস্যার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। সেই সাথে বেলের পাতার রস, মধু ও গোলমরিচের গুঁড়া মিশিয়ে পান করলে জন্ডিসের মতো রোগ নির্মূল হয়ে যায়। পাশাপাশি শিশুর স্মরণশক্তি বাড়ানোর জন্যেও অত্যন্ত উপকারী একটি ফল। তাহলে আজকে বেলের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সমূহ জেনে নেই-
যেকারণে বেল খাবেন, বেলের অবাক করা উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সমূহ
এটিই একমাত্র ফল, যেটা প্রাচীন সময়কাল থেকে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সবচেয়ে উপকারী ফল হিসেবে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। এরমধ্যে এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান তো আছেই, তাছাড়াও আরও রয়েছে অনেক পুষ্টি গুনাগুন যেগুলো প্রত্যেকটি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। এতে থাকা অনেক অনেক পুষ্টি উপাদান গুলোর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপাদানগুলো হলো- ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়াম।
পুষ্টিবিদদের পরীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রতি ১০০ গ্রাম বেলের শাঁসে রয়েছেঃ
- পানির পরিমাণ ৫৪.৯৬-৬১.৫ গ্রাম,
- প্রোটিন ১.৮-২.৬২ গ্রাম,
- স্নেহ পদার্থ ০.২-০.৩৯ গ্রাম,
- শর্করা ২৮.১১- ৩১.৮ গ্রাম,
- ক্যারোটিন ৫৫ মিলি গ্রাম,
- থায়ামিন ০.১৩ মিলিগ্রাম,
- রিবোফ্লাভিন ১.১৯ মিলিগ্রাম,
- এসকরবিক এসিড ৮-৬০ মিলিগ্রাম,
- নিয়াসিন ১.১ মিলিগ্রাম ও
- টারটারিক এসিড ২.১১ মিলিগ্রাম।
আরও পরুনঃ আপেল এর উপকারিতা
বেলের উপকারিতা
এবার চলুন বেলের উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেই-
১. ক্যান্সার ও টিউমার প্রতিরোধে বেলঃ খালি পেটে বেল খাওয়ার উপকারিতা রয়েছে প্রচুর। বেলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমূঘ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্য সম্পাদন করে থাকে। চিকিৎসকদের পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত বেলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এতটাই শক্তিশালী যে, শরীরের যেকোনো ক্যান্সার যেমন ধরুন, স্তন ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার সহ প্রভৃতি রোধে বেল বিশেষ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এতে থাকা বিটা-ক্যারোটিন মানবদেহের টিউমার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে। আমরা সবাই কমবেশি জানি, নারীদের সচরাচর স্তন ক্যান্সার ও জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই, একজন নারী যদি নিয়মিত বেলের শরবত খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন, তাহলে অনেকটাই এই ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে দূরে থাকতে পারবেন। যারা বেল খেতে পছন্দ করেন তারা তো খাবেনই, পাশাপাশি যারা খুব একটা খান না তারাও খাবার অভ্যাস গড়ে তুলবেন। কারণ, নিয়মিত বেল খাওয়ার অভ্যাস আপনাকে দেবে ক্যান্সারের মতো রোগ থেকে সুরক্ষা।
২. কিডনি সুস্থ রাখতে বেলঃ কিডনি এমন একটি অংশ, যা একবার নষ্ট হয়ে গেলে মানুষের জীবন শেষ। আর সেই কিডনি ভালো রাখতে বেল এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জানলে অবাক হবেন, এতে থাকা বিভিন্ন উপকারী পুষ্টি উপাদানগুলো কিডনিকে ডিটক্সসিফাই করতে সাহায্য করে। যারফলে এটি যেকোনো অসুখ থেকে মুক্তি পায়।
৩. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে বেলঃ এটা হয়তো সবাই জানেন, কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে এই ফলের কার্যকারিতা অপরিসীম। বেল যে পেট পরিষ্কার রাখে একথা বৈজ্ঞানিকভাবেও সত্য। জানা যায়, নিয়মিত টানা তিন মাস যদি বেল খাওয়া যায় তাহলে কখনও সেই মানুষটিকে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাতে আর পড়তে হবে না। তাই আপনার যদি এই সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে দ্রুত পরিত্রাণের জন্য নিয়মিত বেল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
৪. গ্যাস্ট্রিক ও পেপটিক আলসার প্রতিরোধে বেলঃ বেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ। আর এটা আমাদের কারোরই অজানা নয়, হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করতে সক্ষম এই ফল। তাই, বেল খেলে পেটে গ্যাসের তেমন কোনো সমস্যা হয় না।
আপনার যদি দীর্ঘদিনের পেপটিক আলসারের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে তো ডাক্তার দেখাতেই হবে, সেইসাথে গাদাগাদা ওষুধ খেতে হবে, কিন্তু তার সঙ্গে বেল খাওয়াটাও খুব দরকার। আর এর অন্যতম কারণ, বেলের সাসে থাকা ফাইবার আলসার উপশমে সাহায্য করে থাকে। যদি কখনও আপনি এমন সমস্যায় পড়েন তাহলে সপ্তাহে তিনদিন বেলের শরবত খান। তাহলে, কিছুদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবেন তার ফলাফল। আর হ্যাঁ, আরেকটা কাজ করতে পারেন, বেলের পাতা সারারাত জলে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সেই জল খেলেও কিন্তু অনেকটাই এই সমস্যা থেকে পরিত্রান পাবেন। তাই গ্যাস্ট্রিক আলসারের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আজই খাবারের তালিকায় যুক্ত করুন এটিকে।
৫. চোখের সমস্যার প্রতিরোধক বেলঃ বেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ, যা চোখের জন্য একটি অত্যান্ত উপকারী পুষ্টি উপাদান। চোখের দৃষ্টিশক্তি প্রখর করতে সেইসাথে চোখের বিভিন্ন রোগ যেমন জেরোসিস, গ্লুকোমা ইত্যাদি থেকে চোখকে রক্ষা করতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে এরমধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলো। শুধু তাই নয়, বেল পাতার রস মধুর সঙ্গে মিশিয়ে পান করলে চোখের ছানি পড়া সমস্যা কমে যায়, সেইসাথে চোখের বিভিন্ন অসুখ হওয়ার প্রবণতাও তুলনামূলকভাবে কমতে থাকে। যেহেতু আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়র মধ্যে চোখ একটি সেহেতু চোখের সুস্থতার জন্য বেল খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
৬. দাঁতের সমস্যার প্রতিরোধক বেলঃ কথাতেই আছে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝে না। তাই, একবার যদি দাঁত পড়ে যায় তাহলেই বুঝবেন দাঁত না থাকার কী যন্ত্রণা।
আমরা সবাই কমবেশি জানি স্কার্ভি দাঁতের একটি মারাত্মক সমস্যা জনিত রোগ। যেটা ভিটামিন-সি এর অভাবে হয়ে থাকে। দাঁতের ক্ষয় হয় মূলত এই রোগের কারণেই। এক সময় প্রচন্ড যন্ত্রণা সহ্য করে পরবর্তীতে নিজের দাঁতটাকেই হারাতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র বেল খাওয়ার অভ্যাস আমাদেরকে মুক্তি দিতে পারে এই সমস্যা থেকে। কারণ, এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি আর এটি সম্পূর্ণভাবে স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরিশেষে, বলা যায় স্কার্ভি রোগীদের জন্য একটি আদর্শ ফল বেল।
৭. ঠান্ডা জনিত সমস্যার প্রতিরোধক বেলঃ সর্দি-জ্বর আমাদের হরহামেশাই হয়ে থাকে। কিন্তু জানেন কি কোনো টাকা খরচ না করেও আপনি দ্রুত সর্দি জ্বর থেকে সেরে উঠতে পারেন? আশ্চর্য মনে হলেও এটাই সত্যি, কারণ ঠান্ডা জনিত সমস্যার পাশাপাশি বিভিন্ন জ্বর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব শুধু মাত্র এক চামচ বেল পাতার রস খেলে। যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে একবার আমাদের টিপসটি ফলো করুন তাহলেই পেয়ে যাবেন এর ফলাফল।
৮. আমাশয় নিরাময়ে বেলঃ নাভির কাছে চিনচিনে ব্যথা, টক বমি সব মিলিয়ে খুব বাজে একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় আমাশয় হলে। কিন্তু বেলের কাছে এটি কমাবার আশ্চর্য এক ম্যাজিক রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন হবে একটি কাঁচা বেল। আর এই কাঁচা বেলের উপকারিতা দেখলে আপনি চমকে যাবেন। আপনি যদি এই সময়ে কচি বেল টুকরো করে কেটে জলে ভিজিয়ে সারারাত রেখে দেন, আর সেই জল পরের দিন ছেকে নিয়ে খান, দেখবেন খুব তাড়াতাড়ি আপনি সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন।
৯. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বেলঃ উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা প্রায় লোকেরই আছে। যাদের ব্লাড প্রেসার হাই তাদেরকে বলছি, আপনি যদি বেলের ভক্ত নাও হন, তবুও বেল খান। কারণ, এটি এমন একটি ফল যা আপনার ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখবে। বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত, শরীরের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বেলের শরবত অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে হ্যাঁ, শরবত বানিয়ে না খেয়েও আপনি যদি শুধু বেল খান তবুও এর ফল পাবেন।
১০. শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে বেলঃ আমাদের শরীরে পুষ্টির অভাবে শক্তির ঘাটতি দেখা দেয়। এমন অনেক সময়ে আমরা একটু কাজ করতেই হাঁপিয়ে যাই। কিন্তু এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বেল সাহায্য করে। কারণ, এতে রয়েছে ১৪০ ক্যালরি এনার্জি, যা আমাদের শরীরকে প্রচুর পরিমাণে শক্তি যোগাতে সক্ষম।
১১. শরীরকে সতেজ রাখে বেলঃ গরমে শরীর খুব ক্লান্ত, একদম নাড়াচাড়া করতে পারছেন না? সেই সময় টপ করে খেয়ে নিন এক গ্লাস বেলের শরবত। তাহলেই দেখবেন আপনার শরীর একেবারে সতেজ হয়ে উঠেছে। কারণ, এতে আছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, যা শরীরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং পেশীকে মজবুত করা সহ দেহকে সচল রাখতে সাহায্য করে।
তাই সবশেষে এটা না বললেই নয়, নানাবিধ শারীরিক উপকারিতা পেতে এই গরমে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই রাখা উচিত পুষ্টিগুণে ভরপুর ফল বেলকে।