কলার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
কলার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ অবিশ্বাস্য। কলা যেমন সহজে এবং স্বল্প দামে পাওয়া যায় তেমনি আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করে থাকে। শুনতে কিছুটা আশ্চর্যের হলেও পুষ্টিবিদদের পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত যে, দেহের এমন কিছু সমস্যা রয়েছে যা রোধে ঔষধ এর থেকে এই ফল অনেক বেশী কার্যকরী।
আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন যারা মনে করে থাকেন, কলাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি। তাই, ডায়েটের জন্য এটি একদমই উপযুক্ত ফল নয়। কিন্তু তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আর এমন কিছু ভুল ধারণার কারণে অনেকেই এই পুষ্টিকর ফলটি থেকে দূরে থাকেন।
আমরা আপনাদেরকে জানাবো দামে সস্তা আর পুষ্টিগুণে ভরপুর কলার উপকারিতা সম্পর্কে, যেগুলো জানলে আপনার চোখ কপালে উঠবে।
আরও পড়ুনঃ সেক্সে রসুনের উপকারিতা
কলার উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সমূহ
আমরা সবাই কমবেশি জানি ক্যালরির চাহিদা মেটাতে সবচেয়ে সহজলভ্য ফল কলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো এটি কি শুধুমাত্র আমাদের শরীরের ক্যালরি চাহিদা পূরণ করে নাকি এর বাইরে অন্য কোনো পুষ্টি উপাদানের যোগান দিয়ে থাকে?
আসলে এর সঠিক উত্তর হবে এই ফল আমাদের শরীরে ক্যালোরির পাশাপাশি বেশ কিছু খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনের যোগান দিয়ে থাকে। কারণ, কলাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফেট, প্রোবায়োটিক সহ প্রভৃতি উপাদান।
যেগুলো আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। সত্যি বলতে কলা এমন একটি ফল যার পুষ্টি গুণ বলে শেষ করার মত নয়। এটি মূলত বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক উপাদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ফল। এমন অনেক ফল রয়েছে যেগুলো কাঁচা এবং পাকার দুইভাবে খাওয়া হয়ে থাকে। সেইসব ফলগুলোর মধ্যে একটি হলো কলা।
আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, কাঁচা অবস্থায় এ ফলের যে পুষ্টি উপাদানগুলো বিদ্যমান থাকে, পাকা অবস্থায় তা বদলে গিয়ে অন্য পুষ্টি উপাদানে পরিণত হয়। আর তাইতো কাঁচা এবং পাকা দুই ধরনের কলাই আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য উপাদান।
আরও পড়ুনঃ পেয়ারার উপকারিতা
আর এসব কারণেই পৃথিবীর ইউনিক ফ্রুটস, সুপারফুড নামে অভিহিত করা হয়েছে এই ফলকে। আর এজন্যই প্রায় সব দেশেই কলার কদর রয়েছে। জানা যায় প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কলায় ক্যালরির পরিমাণ ১০৯ কিলোক্যালরি, প্রোটিন ৭ মিলিগ্রাম, শর্করা ২৫ মিলিগ্রাম, চর্বি ০.৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-১ ০.১০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ ০.০৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি ২৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-এ ৮০ মাইক্রো গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৩ মিলিগ্রাম এবং লোহ ০.৯০ মিলিগ্রাম।
আর এই প্রত্যেকটি পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী যা আলাদা আলাদাভাবে আমাদের শরীরকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তাই, আসুন এবার ফটাফট জেনে নেই কাঁচাপাকা দুই ধরনের কলার গোপন কিছু উপকারিতা সম্পর্কে।
কলার উপকারিতা
১. শক্তির অন্যতম উৎস কলাঃ স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট হেলদি ফুড সম্প্রতি জানিয়েছেন, অনেক ফলের মধ্যে কলা হচ্ছে শক্তি যোগান এর অন্যতম উৎস। বলা যায় এনার্জি বাড়াতে এর জুড়ি মেলা ভার। তাই, যদি কখনও শরীর খুব দুর্বল হয়ে যায় অথবা কোনো কাজ করার এনার্জি না আসে তাহলে দ্রুত কলা খেয়ে নিন। দেখবেন আপনার শরীর ভেতর থেকে চাঙ্গা হয়ে উঠছে আর আপনি যেকোনো কাজে আগ্রহ ও এনার্জি খুঁজে পাচ্ছেন।
২. শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে কলাঃ সবুজ কলাতে রেসিস্ট্যান্ট স্টার্চের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এবং শর্করার পরিমাণ অত্যন্ত কম থাকে। কিন্তু তা পাকার সঙ্গে সঙ্গে রেসিস্ট্যান্ট স্টার্চ শর্করায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। আর তাই পরবর্তীতে পাকা কলায় শর্করার পরিমাণ অধিক হারে বৃদ্ধি পায়। সেইসাথে এতে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। পাশাপাশি কাঁচা কলাতে আরও থাকে অ্যামাইনো এসিড, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন-সি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এর মতো উপাদান সমূহ। এগুলো প্রত্যেকটি আমাদের শরীরের আলাদা আলাদা কার্য সম্পাদন করে, আর পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে।
আরও পড়ুনঃ তেতুলের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
৩. ওজন কমানোর উপায় কলাঃ যাদের ওজন অধিক বেশি, দিনরাত ডায়েট করে যাচ্ছেন তবুও আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না তাদের জন্য আদর্শ ফল এটি। কারণ, কাঁচা কলার ভর্তায় থাকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। আর এই ফাইবার অনেকক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে, যে কারণে খুব সহজে ক্ষুধা লাগে না। ফলে অন্য খাবার খুব বেশি না খাওয়ার জন্য ওজন দ্রুত হারে হ্রাস পায়। আপনি যদি ওজন কমানোর কথা ভেবে থাকেন তাহলে ডায়েট চার্টে কলাকে রেখে দিন।
৪. বিষণ্ণতা রোধ করে কলাঃ হয়তো এটা শুনে অনেকেই অবাক হয়ে যাবেন এবং মনেমনে ভাববেন কলা কিভাবে বিষণ্নতা দূর করতে পারে। তবে আশ্চর্যের মনে হলেও এটি একদম সত্যি কারণ, এতে থাকা অ্যামাইনো এসিড মানসিক চাপ রোধক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়াও ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে বিষণ্ণতা রোধের কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
৫. কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে কলাঃ কলাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। আর ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দূরে রাখতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে থাকে।
৬. হজমে সাহায্য করে কলাঃ এককথায় পেট পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি হজম শক্তি বৃদ্ধিতে কলার জুড়ি মেলা ভার। কারণ, প্রতি একটি কলাতে রয়েছে তিন গ্রাম ফাইবার। আর এই ফাইবার খুব তাড়াতাড়ি খাবার হজম করতে সহায়তা করে।
৭. বাচ্চাদের প্রথম শক্ত খাবার কলাঃ ছোট শিশুদের নিয়ে বাবা মায়েরা খুবই চিন্তিত থাকেন। তাই বাচ্চাদের প্রথম শক্ত জাতীয় খাবার খাওয়ানোর সময় কী ফল দিলে ভালো হবে সেটা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু সম্প্রতি ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়ে থাকেন বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য প্রথম শক্ত খাবার হলো কলা, যা তাদের শরীরের জন্য উপকারী।
৮. ডায়াবেটিকস যোদ্ধা কলাঃ এতে থাকা ভিটামিন বি-৬ রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই, যারা ডায়াবেটিসের রোগী তাদের নিয়মিত কলা খাওয়া জরুরি।
৯. ডায়রিয়া জনিত রোগের সমাধান কলাঃ ডায়রিয়া ও পেটের নানা সমস্যা দূরী করণের একটি উপকারী ও কার্যকরী খাবার কাঁচা কলা। এতে বিদ্যমান পুষ্টি ও খনিজ উপাদান গুলো ডায়রিয়া জনিত রোগের বিরুদ্ধে শরীরকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে কলাঃ কোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ দূর করতে কলার ভূমিকা অপরিসীম বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদরা। এটি এমন একটি ফল যার মধ্যে রয়েছে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত শক্তিশালী পুষ্টি উপাদান।
১১. মাথা ব্যথা ও বাতের সমস্যার প্রতিরোধক কলাঃ আমাদের যাদের স্বাভাবিক মাথাব্যথা ও বাতের ব্যথা জনিত সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য একটি আদর্শ খাবার কলা। কারণ, প্রাকৃতিক ভেবে এসব সমস্যা নিরাময়ে কলা ভালো কাজ করে আর এটা চিকিৎসকদের পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত।
আরও পড়ুনঃ বেলের উপকারিতা
১২. হরমোন জনিত সমস্যার সমাধান করে কলাঃ যাদের হরমোনাল সমস্যা রয়েছে তাদেরকে চিকিৎসকরা প্রায়ই এই ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারণ, এটি দেহের হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে।
১৩. গর্ভবতী মহিলাদের আদর্শ খাবার কলাঃ সন্তান সম্ভবা নারীর জন্য এই ফল অত্যন্ত উপকারী। কেননা কলা সকাল বেলার দুর্বলতা কাটাতে কাজ করে এবং রক্তের শর্করার সামঞ্জস্যতা বজায় রাখে।
১৪. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে কলাঃ কলাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং সামান্য পরিমাণ লবণ, যা শরীরকে ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও বিশেষ ভূমিকা রাখে।
১৫. পানির ঘাটতি পূরণ করে কলাঃ আগের রাতে বেশি তেল মসলাদার খাবার খাওয়া হলে পরের দিনও তার একটা প্রভাব থেকে যায়। তাই একটু পর পর পানি পিপাসা লাগে। কিন্তু কলা পটাশিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় এই সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এজন্য চিকিৎসকরা এই ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাছাড়াও কলা আর মধু দিয়ে তৈরি স্মুদি স্নায়ুর উত্তেজনা কমায়।
তাহলে বুঝতেই পারছেন এই ফল আমাদের শরীরের জন্য কতটা উপকারী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কলা কী যখন তখন খাওয়া যাবে নাকি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে খেতে হবে?
আরও পড়ুনঃ আপেল এর উপকারিতা
কলা কখন কিভাবে খাবেন?
কলা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে সাধারণ কয়েকটি প্রশ্ন হলো – কলা আসলে কখন খাওয়া উচিত? দিনে নাকি রাতে? রাতে নাকি সকালে? খালি পেটে না ভরা পেটে? ইত্যাদি অনেক প্রশ্নই সবার মনেই আসে যায়।
তাদের এই সকল প্রশ্নের উত্তর হলো, সকালে কলা খাওয়ার উপকারিতা সব চেয়ে বেশি ভালো। কারণ, সকালে কলা খেলে সারাদিন এর উপকারিতা পাওয়া যায়। কিন্তু হ্যাঁ, এটি সকালে খেতে পারেন তবে একদম খালি পেটে খাওয়া ঠিক হবে না। তাই, অবশ্যই হালকা কোনো কিছু খাবার পরবর্তীতে খাবেন কিংবা খাবারের সাথে মিশিয়ে নিবেন।
তবে হ্যাঁ, ভারী খাবার এর সঙ্গে কলা না খাওয়াটাই ভালো। সাধারণত খাবার খাওয়ার এক থেকে দেড় ঘন্টা পরে এটি খাবেন। কারণ, সময়ের ব্যবধানে খেলে কলাতে থাকা প্রচুর পরিমাণে ফাইবার পাকস্থলি সহজে গ্রহণ করতে পারে।
আবার আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন যারা সরাসরি এই ফলটি খেতে পছন্দ করেন না। তাদেরকে বলবো, সেক্ষেত্রে আপনারা স্মুদির সঙ্গে মিশিয়ে, সাবু মেখে বা কলা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন নাস্তা বানিয়ে খেতে পারেন। এতে করে আপনার খেতেও ভালো লাগবে সেইসাথে আপনার শরীরে সকল প্রকার পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হয়ে যাবে।